একজন দেশপ্রেমিক জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চির বিদায়

superadmin | আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৩ - ০৩:০১:১০ এএম

১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকেই আপামর জনসাধারণ যখন দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করা শুরু করেছে, ঠিক তখন বিলাত অর্থাৎ ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে এক সন্ধ্যা বেলায় পাতলা, লিকলিকে কৃষ্ণকায় এক বাঙালী যুবক তার ব্যাগ গোছগাছ করছে। চোখ তার রক্ত জবার মত লাল। তার সমস্ত শরীরে যেন এক উম্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে। মনটা তার কিক্ষুব্ধ। সে তার শিক্ষা জীবন অসমাপ্ত রেখেই যুদ্ধে চলে যাচ্ছে।

১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় সে মেধার পরিচয় দিয়েই উত্তীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু এফআরসিএস পড়াকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে সে চূড়ান্ত পর্ব শেষ না-করে লন্ডন থেকে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার নিমিত্তে আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেয়ার উদ্যেশ্যে ব্যাগ গোছাচ্ছে। সে যে যেতে চায় বাংলাদেশ নামক নতুন এক দেশ সৃষ্টির লড়াইয়ে সূর্য রং কোন এক ভোরের আসরে।

যুবক রাতের ফ্লাইটেই চলে যায় ভারতে। এরপর সে পৌঁছে যায় ত্রিপুরার আগরতলায়। আগরতলা পৌঁছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মেলাঘর গেরিলা প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করে সে যুবক। সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সকল কলাকৌশল শিখে নিতে শুরু করল যুবক। প্রশিক্ষণ শেষেই সে প্রবেশ করবে যুদ্ধের দেশ বাংলাদেশে। মুক্তিবাহিনীর একজন যোদ্ধা হিসাবে সে লড়াই করবে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে।

প্রশিক্ষণ গ্রহণের এক পর্যায়ে সে দেখল, শত শত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আগরতলায় আসছে চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্যে। গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই পূর্ব পাকিস্তান নামক যুদ্ধরত বাংলাদেশের কোথাও। যুবক বাংলাদেশে সরাসরি যুদ্ধ করার চেয়ে যুদ্ধাহত মুক্তি যোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আবারও যুদ্ধের ময়দানে পাঠানোকে অধিকতর শ্রেয় মনে করল। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বিলাত থেকে আসা যুবক ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করা একজন চিকিৎসকও বটে।

আগরতলায় তিনি পেয়ে গেলেন ডাঃ এম এ মবিনকে। তার সাথে মিলেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট “বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল” প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা শুরু করলেন। যুবক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া ছাড়াও আরেকটি কাজ শুরু করলেন। যুবক স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য জ্ঞান দান করেন যা দিয়ে তারা নার্স হিসাবে রোগীদের সেবা করত এবং তার এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার “ল্যানসেট”-এ প্রকাশিত হয়।

১৯৭১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা মেলাঘর গেরিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সেই যুবক চিকিৎসক আজ মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল ২০২৩) রাত সোয়া ১১টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্যে সেদিনের সেই যুবকের নাম ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. মামুন মোস্তাফী মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

সোমবার (১০ এপ্রিল) ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। মঙ্গলবার দুপুর ২টা ১৫ মিনিট থেকে তাঁর কিডনির ডায়ালাইসিস শুরু হয়। একই সঙ্গে চলে অন্যান্য চিকিৎসা। তিনি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে ভেন্টিলেশনে ছিলেন। এড় আগে, গত ৭ এপ্রিল মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর ধানমন্ডির নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে। দীর্ঘদিন ধরে কিডনির জটিলতার পাশাপাশি গত কয়েকদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানান জটিলতায়ও ভুগছিলেন তিনি।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য সক্রিয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামক স্বাস্থ্য বিষয়ক এনজিওর প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮২ সালে প্রবর্তিত বাংলাদেশের ‘জাতীয় ঔষধ নীতি’ ঘোষণার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

ডাঃ জাফরুল্লাহর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে। তাঁর বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড় । ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে রামন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড (১৯৯২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন।২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার পান।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির একজন কারিগর যেমন ছিলেন ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঠিক তেমনি মৃত্যু মুহূর্তের ৭ দিন আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন একজন সাহসী দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। আসুন আমরা সকলে এই দেশপ্রেমিক, সাহসী মানুষটির বিদেহী আত্মার শান্তির জন্যে প্রার্থনা করি। পরম করুনাময় আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেস্ত নসীব করেন। আমিন।

কিউটিভি/রুমা //এল আর/ ১১ এপ্রিল ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ/ রাত ১১.৫০

▎সর্বশেষ

ad