
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : আমার নাম মোনা আবু হামদা। বয়স ২৭। দক্ষিণ গাজার নাসের হাসপাতালের পাশেই আমার পৈতৃক ঠিকানা। আমার জন্মভূমি গাজা উপত্যকা পৃথিবীর এমন একটি ‘কয়েদি ভূখণ্ডে’, যা বিশ্ববাসীর কাছে কেবলই ব্যথা আর সংবাদ শিরোনামের মাধ্যমে পরিচিত।
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় বর্তমানে স্থায়ী কোনো আশ্রয়স্থল নেই। শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে পাতলা ও ছেঁড়াফাটা তাঁবুর ঘর। কিছু এলাকা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। সেখানে আর কোনো ঘর নেই, জীবনের কোনো চিহ্ন নেই। কিছু এলাকা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়েছে। আবার কিছু এলাকায় ঘর, রাস্তা এবং অন্যান্য পরিষেবা অক্ষত রয়েছে।
শুধু বাসস্থান নয়, খাবারের অভাবেও (এখনো) ধুঁকছে গাজাবাসী। গণহত্যার প্রথম দিনগুলোয় খাবার দ্রুত শেষ হয়ে যায়। ইসরাইলি হামলায় বাজার ধ্বংস হয়ে গেছে। গুদামগুলোও পুড়ে গেছে। ইসরাইলের নির্দেশে সীমান্ত বন্ধ হওয়ায় ভয়াবহ ক্ষুধার কবলে পড়ে গাজা। আমরা দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার সময়কাল পেরিয়েছি। আমাদের খাবার বলতে ছিল শুধু এক টুকরো রুটি। দামও বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছিল। এক কেজি আটার দাম হয়েছিল ২৫ ডলার, এক কেজি ডালের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৫ ডলারে।
বর্তমানে ধীরে ধীরে কিছু খাবার আবারও পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য আসছে। বর্তমানে ত্রাণে চলছে গাজাবাসী। খান ইউনিসের দৈনিক বাজার আবারও জীবন্ত হয়ে উঠছে। এখানে সবজি ও ফলের বিক্রেতাদের দেখা যাচ্ছে। বাজারে কেবল চাল, তেল, ডাল, ক্যানড ফুড, চিনি, লবণ, আটা এবং অন্যান্য খাবারের জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার পর এগুলোর দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু ডিম, মাংস বা মুরগি এখনো নেই। আমি শেষবার মুরগি খেয়েছিলাম ২০২৫ সালের মার্চের শুরুতে। প্রায় ৭ মাস আগে। সবজি ও ফলের দাম এখনো বেশি। খুব কম মানুষই এক কেজি ফল কিনতে পারে।
গাজায় পানি ও স্যানিটেশনের সুব্যবস্থাও নেই। গণহত্যায় অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশুদ্ধ পানি নেই বললেই চলে। স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। ফলে রোগের ঝুঁকি বেড়েছে। মশার উপদ্রব বেড়েছে। এটা আমার জন্য বেশি ভয়ানক। কারণ, আমার মা ২০২৪ সালের জুলাইয়ে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হন। এদিকে রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ধ্বংসপ্রায়। স্কুলগুলো শিক্ষা দেওয়ার বদলে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে থাকার বদলে খাবারের সারিতে দাঁড়াচ্ছে। শিশুরা সংকীর্ণ তাঁবুতে দিন কাটাচ্ছে। তাদের মুখে হাসি নেই।
এখনো ভয় ও উদ্বেগে দিন পার করছে তারা। দুর্ভোগের মধ্যেই প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি নীরবে উদ্যাপন করছে গাজার মানুষ। শান্তির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। যদিও এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভয় জীবনকে এখনো গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে আছে গণহত্যার পুনরাবৃত্তি ও প্রিয়জন হারানোর ভয়। ড্রোনের শব্দ থেমেছে, কিন্তু ব্যথা রয়ে গেছে প্রতিটি হৃদয়ে। কী ঘটেছে, তা বুঝতে আমাদের দীর্ঘ সময় লাগবে। আমরা যা পেরিয়েছি, তা কল্পনার বাইরে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ, আমরা খুশি যে গণহত্যা থেমেছে। আমাদের সবচেয়ে বড় ইচ্ছা হলো শান্তিতে বাঁচা। এই হলো গাজার জীবন ক্ষবিক্ষত, কিন্তু আশাবাদী। আমরা সেই দিনের অপেক্ষা করছি, যখন ঘরগুলো আবার উঠে দাঁড়াবে, শিশুরা অবাধে হাসবে এবং সূর্য তার উজ্জ্বলতা নিয়ে শান্তিপূর্ণ গাজার ওপর আলো ছড়াবে।
আয়শা/১৮ অক্টোবর ২০২৫,/রাত ১০:০০