
নাহিদ-রুমকীর অসমাপ্ত কথোপকথন : জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি
——————————————————————————
নাহিদ অফিস থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তার কোন হলিডে নেই। শুক্রবার, শনিবার বলতে অন্যদিনের তুলনায় তার কাছে কোন ফারাক নেই। কিছু জরুরী ফাইল সই করে সে একা একাই হাসছে। গতকাল রুমকীর সঙ্গে কত কথাই না হলো। অথচ আসল কথাতো আজকেই বলার অনেক কিছু ছিল। গতকাল রুমকীর সঙ্গে কথা বলার পরপরই সরকারী প্রজ্ঞাপন জারী হয়। সকল ধরণের জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই আদেশ গতকাল রাত ১২টার পর থেকেই কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারীর পর থেকেই সারাদেশে এক তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে যায়।
রুমকীর কথা ভাবছে নাহিদ। এর মাঝেই সেলফোনটা ভাইব্রেট শুরু করল। রুমকী নাহিদের হোয়াটস্যাপ নাম্বারে কল দিয়েছে। সেল ফোনটা হাতে নিয়ে নাহিদ একটা লম্বা সোয়াপ করল। অপর প্রান্তে কাকনের রিনিঝিনি ছড়িয়ে কাংখিত কণ্ঠের কলতান সৃষ্টি হল। বলতে গেলে প্রতিদিনই কথা হয় রুমকীর সঙ্গে। তারপরেও প্রতিবার রুমকীর কল রিসিভের সময় নাহিদের বুকে রক্ত ছলকে উঠে।
নাহিদ তুমি কি ব্যস্ত ? কথা বলা যাবে ? রুমকী কিছুটা বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইল। নাহিদ হেসে বলল, তোমার কথাই ভাবছি রুমকী। ভাবছি তোমার সাথে কথা বলে বাসা ফিরব। রুমকী হাফ ছেড়ে বলল, যাক বাবা, আমার কপাল ভাল। তুমি যে আমার কথা এখনো ভাব। নাহিদ পাল্টা জবাব দিল, অন্য কিছু নিয়ে ভাবিনি। ভেবেছি, গতকাল তোমার সঙ্গে কথা বলার পরপরই তেল নিয়ে তেলেসমাতির সরকারী প্রজ্ঞাপন জারি হল আর তুমি এ বিষয়ে কথা বলবেনা তা কি করে হয় ?
রুমকী নিউইয়র্কের কুইন্সের কিউ গার্ডেন্স এর এক বহুতল এপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে প্রথম যে প্রশ্নটা করল সেটা বড় জটিল। রুমকী নাহিদের কাছে জানতে চাইল, প্রথমতঃ এইতো কিছুদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বচ্ছাসেবক লীগের একটি সভায় প্রকাশ্যে একটি তথ্য দেশবাসীকে প্রদান করেছেন, আমাদের পেট্রোল ও অকটেনের কোন সমস্যা নেই। আমরা যে গ্যাস পাই তা থেকে বাই প্রোডাক্ট হিসাবে পেট্রোল ও অকটেন তৈরী হচ্ছে। আমাদেরকে পেট্রোল ও অকটেন কিনতে হয়না। আমাদের যা প্রয়োজন তার থেকে অনেক বেশি পেট্রোল ও অকটেন মওজুদ আছে। আর দ্বিতীয়তঃ হলো, গতকালই সারা দুনিয়ায় লিড নিউজ ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে এক পর্যায়ে ব্যারেল প্রতি ১৩৯ ডলার হয়ে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই কমছে। আজ শনিবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৯০ ডলারেরও নিচে নেমে এসেছে। খবর রয়টার্সের।
রুমকী একটু দম নিয়ে বলল, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ার মুহূর্তে দেশে রেকর্ড গড়ে তেলের দাম বাড়ানো হল কেন ? আমি এর ব্যাখ্যা তোমার কাছে জানতে চাই নাহিদ।
নাহিদ হেসে বলল, পরিসংখ্যান বিবেচনায় এই মূল্য বৃদ্ধির কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। সরকারের ইচ্ছে হয়েছে তাই জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। এরচেয়ে আর কোন উপযুক্ত ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। তবে তোমাকে ভিন্ন একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরতে পারি। রুমকী আগ্রহ নিয়ে বলল, বলো প্লিজ।
নাহিদ শুরু করল তার পরিসংখ্যান। গতকালের সরকারী প্রজ্ঞাপন মোতাবেক প্রতি লিটার অকটেনে ৪৬ টাকা, পেট্রোলে ৪৪ টাকা, ডিজেল ও কেরোসিনে ৩৪ টাকা দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে এটি একটি রেকর্ড। এখন আসো গরিবের পরিবহন নন এসি বাসের ভাড়ায় এর কি প্রতিক্রিয়া পড়বে তা একটু জেনে নেয়া যাক। রুমকী বলল, তুমি বলো নাহিদ, আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছি। নাহিদ আবার শুরু করল।
মঙ্গা পীড়িত, নদী ভাঙ্গন কবলিত কবলিত জেলা কুড়িগ্রাম থেকে প্রতিদিন দেড় শতাধিক বাস ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। রিক্সাচালক, রাজ্ মিস্ত্রি, বিভিন্ন লেবার শ্রেণীর মানুষ, গার্মেন্টস কর্মীরা এই বাসগুলোর মূল প্যাসেঞ্জার। ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামের দূরত্ব ৪০০ কিলোমিটার। ৩৬ সিটের একটি বাস কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকা আসতে অথবা যেতে প্রায় ২৫০ লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে একজন বাস মালিককে অতিরিক্ত ৮৫০০ টাকা ব্যয় করতে হবে এক যাত্রায়। সে ক্ষেত্রে একজন গরিব প্যাসেঞ্জারকে বর্তমানে ৮০০ টাকার স্থলে ২৩৬ টাকা অতিরিক্ত প্রদান করে ১০৩৬ টাকা দিয়ে ঢাকা আসতে হবে। নাহিদের তথ্যে রুমকী বিস্মিত হয়ে বলল, তাহলে এই অবস্থা?
নাহিদ রুমকীকে আরও ভীত সন্ত্রস্ত করে তুললো, তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সব জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যাবে। অলরেডি আজকেই বেড়ে গেছে। মূল্য বৃদ্ধির জন্যে জ্বালানি তেলের ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে সবক্ষেত্রেই এর প্রভাব ছড়িয়ে দেবে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তোমাকে আজ সকালের একটি ঘটনা বলে বিদায় নিচ্ছি। রুমকী বলল, বলো তোমার ঘটনা ?
আজ সকালে টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল ঢাকায়। আমি অফিসে যাব। ড্রাইভারকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মোবাইলও ধরছেনা সে। বাসার গলির মুখে একটা চায়ের দোকানে আড্ডা দেয় ড্রাইভার। আমি খুঁজতে গলির মোড়ে যেতে দেখি এক রিকশাওয়ালা সিটের উপরে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। একজন প্যাসেঞ্জার তার গন্তব্যের কথা বলতেই রিকশাওয়ালা বলল, ৫০ টাকা ভাড়া লাগবে। প্যাসেঞ্জার প্রচন্ড খেপে গিয়ে বলল, এখান থেকে ৩০ টাকা ভাড়া ফিক্সড। তুমি ৫০ টাকা কেন চাও ? রিকশাওয়ালা জবাব দিল, তেলের দাম বেড়েছে, তাই আমার ভাড়াও বেড়েছে। প্যাসেঞ্জার আরও খেপে গিয়ে বলল, আরে বদমাশ, তোমার রিকশাতো তেলে চলেনা। পা দিয়ে তুমি রিকশা চালাও। তাহলে বেশি চাও কেন ? রিকশাওয়ালা রিকশা থেকে নেমে বলল, সকালে বাজার করতে গিয়েছি, তেলের দাম বাড়ানোর অজুহাতে প্রতিটি সবজি ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সব জিনিসের দাম আজ থেকে বাড়তি। এখন বলেন, ভাড়া বেশি চাওয়া কি আমার অন্যায় হয়েছে ? প্যাসেঞ্জারটি কিছুটা শান্ত হয়ে বলল, নাহ, তোমার কোন অন্যায় হয়নি। অন্যায় হয়েছে আমার, এই দেশে জন্মেছি বলে।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
বিপুল /০৬.০৮.২০২২/ রাত ১০.০১