আমাদের সময় বহিয়া যায়। ব্যাংককে এটা আমাদের প্লেজার ট্রিপ নয়। আমরা আমাদের জীবনকে নিরাপদ করার জন্যে দেশ ছেড়েছি। নিরাপত্তার চাদরে আমাদের জীবন ঢেকে আছে ব্যাংককে। এখানে নিরাপত্তাহীনতার মাঝে ঘুমাতে হয়না। এখানে জানালার গ্রিলের স্ক্রু খুলে রেখে ঘুমাতে হয়না। কিন্তু এরপরেও কথা থেকে যায়। আমাদের জীবন চলবে কেমনে ? এখানে জীবন নির্বাহের টাকা আসবে কোথা থেকে?
মধ্যপ্রাচ্যের মরুময় একদেশে সজল, জুয়েলের চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। ওখানে কোন জব না করেই সম্মানজনক ভাবে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। লেখাপড়া, মানবিক কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে। বলতে গেলে সজল জুয়েলের মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান হবে কিছুটা রাজনৈতিক আশ্রয়ের মত।
মুহসিন হল শাখা ছাত্র দলের সাধারণ সম্পাদক ও হল সংসদের এজিএস গাজী কামরুল ইসলাম সজল, সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মির্জা মাসুদ জুয়েল (মরহুম) চলে যাবে মধ্যপ্রাচ্যে। এটা কোন জীবন জীবিকার জন্যে নয়। প্রবাসী পলাতকা সময় টুকুকে অতিবাহিত ও যৌক্তিক কারণে কাজে লাগানোর জন্যে।
আমাদের সবার মন খারাপ। আমরা অজানা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছি। সাঈদ, অশোক সহ আমি ভাবছি, কিভাবে সজল ও জুয়েলকে বিদায় জানানো যায়। এর মধ্যেই ব্যাংককে এসেছেন রেজা মামা। আমাদের সব মন খারাপ করা অনুভূতিগুলো দুলাল ভাই বুঝে ফেললেন। সন্ধ্যায় পার্টি দিলেন তিনি। ঢাকা থেকে আগত আমরাই প্রায় ৭/৮ জন। এর পর দুলাল ভাইয়ের ফ্যামেলী ও আত্মীয় স্বজন। প্রায় ২০ জনের পার্টি।
সকালের ফ্লাইটে চলে যাবে সজল, জুয়েল। বড় ভাইয়ের মন খারাপ খুব। বলতে গেলেই এরা দুজনেই তাঁর সবচেয়ে কাছের। গ্রূপিং পলিটিক্সের পুরোটাই দেখভাল করতো সজল। বড়ভাই কিছুটা অসহায় ও বিভ্রান্ত বোধ করছে। আমিও চলে যাচ্ছি, খুব সহসাই। আপাতত ব্যাংককে শুধু থাকবে বড়ভাই ও সাঈদ সোহরাব।
বিদায়ের রাতটা লাগেজ গোছগাছে চলে গেল সজল জুয়েলের। ওরা ফাওরাতে হোটেলেই ছিল সেদিন। সকাল ১১ টায় গালফ এয়ারের ফ্লাইট ওদের। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে সজল অবাক হয়ে দেখল রুমে জুয়েল নেই। জুয়েলের লাগেজও নেই। হোটেলের রিসেপশনে খোঁজ নিয়ে সজল জানতে পারল, খুব ভোরেই জুয়েল লাগেজ সহ একটা টুকটুক ভাড়া করে এয়ারপোর্ট চলে গেছে। সজল সহজেই বুঝে নিল, জুয়েল মধ্যপ্রাচ্যে যাবেনা। সে দেশে ফিরে গেছে।
আমি সাঈদ, অশোক ওদের দুজনকে এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে ফাওরারাতে এসে সব শুনে আহাম্মক। এ মুহুর্তে জুয়েলের দেশে ফেরা মানে আগ্নেয়গিরির মধ্যে ঝাঁপ দেয়া। আমরা অজানা আশংকায় আতংকিত বোধ করছি। পাগলাটে জুয়েল এমন কিছু করবে এ আর অস্বাভাবিক কি ?
সকাল নয়টায় আমরা এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা দিলাম ট্যাক্সিতে। বড়ভাই রুম বন্ধ করে ছিলেন। বিদায় মুহূর্তে সজলের সংগে দেখা করেননি। হয়ত এই অনাকাংখিত বিদায় পর্ব এড়িয়ে চলার এক প্রচেষ্টা মাত্র । সকালে ব্যাংককের রাস্তা ফাঁকা থাকে। রাতের জৌলুসময় ব্যাংকক সকালে ক্লান্ত হয়ে পরে। সব কিছুই ফাঁকা ফাঁকা। আমাদের ট্যাক্সি শা শা করে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটছে।
সজল চলে যাচ্ছে মরুময় দেশে। যে স্বপ্ন, যে আকাঙ্খা, যে প্রত্যাশা নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু হয়েছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রীয় ভাবে অংশগ্রহণ করতে যেয়ে আমরা দলীয় রাজনীতি আর গ্রূপিং পলিটিক্সের চোরাবালিতে পা ডুবিয়ে প্রবাসী জীবন শুরু করতে হল আমাদেরকে । হয়ত এক দেশ থেকে আরেক দেশে, দেশান্তরী হব আমরা। আজ সজল যাচ্ছে মরুর দেশে,জুয়েল পালিয়ে চলে গেল দেশে, এর পরে আমি চলে যাব অন্য কোথাও। সবাই চলে যাবো । বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি আমরা পরস্পরের কাছ থেকে।
ব্যাংককের আন্তর্জাতিক ডনমুয়াং এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন সীমানা পার করে চলে গেল সজল, স্বেত শুভ্র সকালের হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন সূর্যালোক ভেদ করে। সজলের পথ চাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আমরা। ডিপার্চার লাউঞ্জের রেলিং ধরে সজলের পথের দিকে তাকিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। চলে যাচ্ছে সজল — খুব স্বল্প সময়ে ব্যাংককে যদিও আমাদের একসাথে থাকার সুযোগ হল। কিন্তু সহসাই বিদায় নিয়ে, জানান দিয়ে গেল সজল, আমাদের জীবন থেকে ” চলে গেছে বসন্তের দিন”।
ছবিঃ ১. ব্যাংককের ডনমুয়াং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ডিপার্চার লাউঞ্জ। ২. ঢাবির মুহসিন হল ছাত্র সংসদের সাবেক এজিএস গাজী কামরুল ইসলাম সজল। ৩. ব্যাংককের ট্যাক্সি ক্যাব। ৪. ঢাবির সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরহুম খান এ মির্জা মাসুদ জুয়েল।
লেখকঃ লেখকঃ লুৎফর রহমান। লেখক, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ।
বিপুল/১১ই এপ্রিল, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ |রাত ৮:৩৩