স্পোর্টস ডেস্ক : ফুটবলের যৌবন ক্ষয়ে গেলেও এখনো আলোচনা ফুরায়নি। সেই বিগতযৌবন আমাকে আলোড়িত করে। ভালোমন্দের বর্তমান আমাকে আশাবাদী করে, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। এই স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে আছি। ছেলেবেলায় স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে মাঠে গিয়ে খেলা দেখা, খাতার ভাঁজে স্বপ্নের তারকাদের সংগোপনে লুকিয়ে রাখার আনন্দময় দিনগুলো ভুলি কী করে! মা পুরনো পত্রিকার সঙ্গে আমার সযত্বে রাখা তারকাদের গোলের হিসাবের খাতা, পোস্টার ও ছাপানো ফিচারগুলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন বলে মন খারাপ হয়েছিল। স্মৃতিগুলো হাতছাড়া হলেও ফুটবলমোহ কাটেনি। ফুটবলের সঙ্গে কাটানো সেই আনন্দময় দিনগুলোই সম্ভবত আমাকে ঠেলে দিয়েছে ফুটবল সংগঠনের দিকে। সংগঠকের চোখ দিয়ে দেখলে আমাদের ফুটবলের গৌরব ক্ষয়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ দেখি। দায় আমাদের সবার। সংগঠক, ফেডারেশন, ক্লাব এবং সময়ের কঠিন বাস্তবতাকেও উপেক্ষা করা যাবে না। এই উত্থান-পতনকে জোয়ারের পর ভাটার টান হিসেবে দেখি বলে খুব হতাশ হই না। একে-ওকে দোষারোপ না করে ফুটবল উত্তরণের পথই খুঁজি।
প্রথম ও প্রধান কথা হলো, খেলাটা সারা দেশে আগের মতো হতে হবে। ফুটবল খেলায় যে আকর্ষণ, বিনোদন ও উন্মাদনা রয়েছে কারো পক্ষে তা উপেক্ষা করা সহজ নয়। খুবই স্বাভাবিক, খেলা যত বেশি হবে, খেলোয়াড়ের সংখ্যা তত বাড়বে। আমি চাই আন্ত স্কুল ফুটবল থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী কাপ, জাতীয় লীগসহ সব টুর্নামেন্টের নিয়মিতকরণ। বিনোদন হিসেবে শিশুদের হাতেখড়ি হোক ফুটবলে, উন্নতি হবেই। জেলা ফুটবল লীগগুলোও নিয়মিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে এই লীগগুলোকে। আট বিভাগে আটটি বিভাগীয় ফুটবল লীগও যদি করা যায়, তাহলেও জেলার ফুটবলারদের জন্য আরেকটি ক্ষেত্র তৈরি হয়। ফুটবলের সোনালি দিনগুলোতে দেখেছি, জেলা থেকে এসে একেকজন তারকা হয়েছিলেন ঢাকা মাঠে। এখনো তা-ই দেখছি। এই বাস্তবতা মানতে হবেই আমাদের। কারণ এর কোনো বিকল্প আমরা দাঁড় করাতে পারিনি। এমনও হতে পারে দেশের যেসব জায়গায় ফুটবল-সংস্কৃতি ছিল, সেই জেলাগুলো নিয়ে পরিকল্পনা করতে পারি আলাদাভাবে। ওসব জায়গায় যুব ফুটবল নিয়ে ব্যাপক কাজ করে দেখা যেতে পারে, ফল কী হয়। ভালো মানের ফুটবলার বের করতে এ রকম কিছু পরিকল্পনা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আরেকটি সদ্য উপলব্ধি হলো, সার্ভিসেস দলগুলোকে মূল স্রোতে নিয়ে এলে খেলাটির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আকর্ষণ বাড়বে। সর্বশেষ স্বাধীনতা কাপে বাংলাদেশ পুলিশ দলের দিকে তাকান। তাদের দেশি ফুটবলার খারাপ নয়, সঙ্গে যোগ হয়েছে কয়েকজন ভালো বিদেশি। এবার লীগে তারা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে যেকোনো বড় দলকে। তাদের দেখে উদ্দীপ্ত হতে পারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ অন্য সার্ভিসেস দলগুলো। তাদের সুবিধা হলো, অবকাঠামো ও অর্থ আছে। অন্যান্য খেলায় তারা নিয়মিত খেলতে পারলে ফুটবল কেন নয়? আমাদের ফুটবল ফেডারেশন থেকে উদ্যোগ থাকলে অবশ্যই সার্ভিসেস দলগুলো আগ্রহী হবে। তাতে লীগ আরো শক্তিশালী হবে। এর সঙ্গে আরো কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ফুটবলে যোগ করা গেলে খুব ভালো হয়। যত যা-ই বলি, অর্থ ছাড়া ফুটবল দল চালানো কঠিন।
এটা ঠিক, এ অবস্থায় করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে ফুটবলে আগ্রহী করাটা কঠিন। তবে তিন-চার বছর ধরে দেশে যে ফুটবলের ধারা তৈরি হয়েছে, সেটা ইতিবাচক। ক্লাবগুলো এখন আফ্রিকানদের বিদায় করে ঝুঁকেছে ইউরোপিয়ান ও লাতিন ফুটবলারদের দিকে। বিশ্বকাপার ড্যানিয়েল কলিনদ্রেসকে ঢাকায় এনে ফুটবলে নতুন মোহ তৈরি করেছে বসুন্ধরা কিংস। এখন অন্য ক্লাবগুলোও আনছে ভালো বিদেশি। ফলে ঘরোয়া ফুটবল আগের চেয়ে অনেক জমজমাট। কেউ একটা ভালো জিনিসের সূচনা করলে দুদিন পর অন্যরাও হাঁটবে সেই পথ ধরে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। তাই দেশের বড় ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে ফুটবল সংস্কারে। তারাই নতুন কিছু যুক্ত করে বেগবান করতে পারে নতুন ধারাকে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা হয়তো পুরোপুরি ইউরোপের ধাঁচে চালাতে পারব না, তবে অনেক কিছু করার সাধ্য আমাদের আছে। যেমন—প্রিমিয়ার লীগের দলগুলো দুটি করে বয়সভিত্তিক দল চালাতে পারে। নির্দিষ্ট ট্রেনিং প্রগ্রামে থাকার কারণে ওসব ফুটবলারের গুণগত মান বাড়বে। এ জন্য কিছু বাড়তি খরচ হবে। তবে লাভও আছে। দলবদলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে বাইরে থেকে খেলোয়াড় কিনতে হবে না, এমনকি ভালো দামে অন্য ক্লাবের কাছে বিক্রি করারও সুযোগ থাকে।
সংস্কার দরকার ফুটবল ফেডারেশনের চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনায়। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে আমাদেরও বিশ্ব ফুটবলের দলবদলের সময়টাকে আলিঙ্গন করতে হবে। সেটা হয় না বলে ক্লাবগুলোর ইচ্ছা থাকলেও ভালো মানের বিদেশি খেলোয়াড় আনতে পারে না। আবার মৌসুম ঠিকঠাক না হলে বা পেছালে ক্লাবগুলোকে বাড়তি টাকা গুনতে হয় বিদেশি ফুটবলারদের জন্য। তাই মৌসুম ও দলবদলের সময় প্রতিবছর যেন একই থাকে, সেই ব্যবস্থা করা খুব জরুরি। ঘরোয়া ফুটবলকে ফলদায়ী করতে সংস্কার করতে হবে নিচের লীগগুলোতে। কোনো ফুটবলার যেন একই মৌসুমে বিভিন্ন লীগে (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ) খেলতে না পারে, এ জন্য মহানগরী লীগের দলবদল হওয়া উচিত একই সময়ে। এক ফুটবলার তিন লীগ খেলে বেড়ালে নতুন খেলোয়াড় আসার সুযোগ কোথায়?
আসলে সামনে এগোতে গেলে সব ধরনের ফুটবলীয় কর্মকাণ্ডে লাগবে যৌক্তিক ও আধুনিক চিন্তা। এ জন্য খুব জরুরি হলো ফুটবল ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিদের আন্তরিকতা ও বাস্তব বুদ্ধি। আমিও ফুটবল ফেডারেশনে আছি, নিজেকে ধরেই বলছি, আমাদের মধ্যেও অনেক গলদ আছে। চিন্তার দৈন্য আছে। পরিকল্পনাহীনতা আছে। যেমন—আমরা এখনো জাতীয় দলের জন্য পেশাদার ম্যানেজার নিয়োগ করতে পারিনি। অথচ সাফল্যের জন্য এটা খুব জরুরি। বাফুফের চেয়ারে বসে নিজেদের নানা স্বার্থ বা ক্লাবের ঊর্ধ্বে উঠে সামগ্রিক ফুটবলের শুভচিন্তা করতে না পারলে শুভদিনও ফিরবে না। মাঝপথে লীগ বন্ধ করে ঘরোয়া ফুটবলের বিঘ্ন ঘটিয়ে লম্বা ক্যাম্প করে জাতীয় দলকে সমৃদ্ধ করা যায় না। পুরনো ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। ফুটবলের জন্য বিকেএসপির মতো একটা ‘সেন্টার ফর এক্সিলেন্স’ তৈরির সময় হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এটা খুবই সামান্য চাওয়া।
লেখক : সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)
সভাপতি, বসুন্ধরা কিংস
কিউটিভি/আয়শা/১২ই জানুয়ারি, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/বিকাল ৩:৪০