ইসলামী আইনের চোখে সামাজিক রীতিনীতি

Ayesha Siddika | আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ - ০৪:৩২:৪৯ পিএম

ডেস্ক নিউজ : সামাজিক প্রথা, প্রচলন ও রীতিনীতি বোঝাতে আরবিতে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয় : উরফ ও আদত। আরবি ‘উরফ’ শব্দের অর্থ কল্যাণ, স্বীকৃত, অনুমোদিত ও কোনো কিছুর ধারাবাহিকতা। আর আদত হলো অভ্যাস। আল্লামা মোস্তফা আহমদ জারকা (রহ.) লেখেন, ‘মানুষ যখন কোনো কিছুর প্রতি ঝুঁকে যায় এবং তাতে স্বস্তি পায়, তখন তা বারবার করার মাধ্যমে অভ্যাসে (আদত) পরিণত হয়। যখন কাজটি অন্য কেউ করে এবং সমাজের বেশির ভাগ মানুষের ভেতর তার বিস্তার ঘটে, তখন তা উরফ বা প্রথার স্তরে উন্নীত হয়। উরফ মূলত বিপুলসংখ্যক মানুষের অভ্যাস। অভ্যাসটি কথার ক্ষেত্রে যেমন হতে পারে, তেমন কাজের ক্ষেত্রেও হতে পারে। (আল-মাদখালুল ফিকহিল আম, পৃষ্ঠা ৮৩৩)

আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা

১. কোরআন : পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে আল্লাহ উরফ বা সমাজের সাধারণ রীতিকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্তন্য পানকাল পূর্ণ করতে চায়, তার জন্য মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর স্তন্য পান করাবে। পিতার দায়িত্ব প্রথামাফিক তাদের ভরণ-পোষণ করা।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৩)

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা তাদের সংস্থানের ব্যবস্থা কোরো, সচ্ছল তার সাধ্যমতো এবং অসচ্ছল তার সামর্থ্যানুযায়ী বিধিমতো (সামাজিক মানদণ্ড অনুপাতে) খরচপত্রের ব্যবস্থা করবে। এটা নেককার লোকদের কর্তব্য।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৩৬)

অন্য হাদিসে এসেছে, মুসলিমরা যা ভালো মনে করে আল্লাহর কাছে তা ভালো, আর মুসলিমরা যা খারাপ মনে করে আল্লাহর কাছে তা খারাপ। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৩৬০০)

এ হাদিসটি যদিও প্রধানত ইজমাকেই সুদৃঢ় করে, তবে এর দ্বারা জনমতের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।

৩. ইজমা : সব যুগের মুজতাহিদ আলেমরা উরফকে ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা কর্মসূচক ইজমার মাধ্যমে উরফের প্রমাণ পেশ করেছেন। ইসলামী শরিয়তের এমন বহু বিধানের ব্যাপারে ইজমা সম্পন্ন হয়েছে, যার ভিত্তি ছিল উরফ। যেমন—ইস্তিসনা চুক্তি তথা পণ্য তৈরি করে দেবে—এই মর্মে কারিগরকে মূল্য পরিশোধ করা।

৪. কিয়াস : বিয়ে, তালাক, পারস্পরিক লেনদেনসহ বহু বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) তৎকালীন সামাজিক রীতিকে আইনের মর্যাদা দান করেছেন। সুতরাং সামাজিক রীতিনীতি ইসলামী শরিয়তের মূলনীতিবিরোধী না হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। (ইসলামী আইনের উৎসসমূহ, পৃষ্ঠা ১৬৯)

প্রথা-প্রচলন গ্রহণের শর্তাবলি

ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা-প্রচলন গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আল্লামা মোস্তফা আহমদ জারকা (রহ.) চারটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। তা হলো :

২. আইন হিসেবে গ্রহণের সময়ও তা প্রচলিত থাকা। যে প্রথা-প্রচলন সমাজের মানুষ পরিত্যাগ করেছে, তা আইনের উৎস হতে পারবে না।

৩. প্রথা-প্রচলনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা বা বক্তব্য না থাকা। অর্থাৎ বিষয়টি সবার কাছে অভিন্ন অর্থে হওয়া। তা পালনকারীদের মধ্যে অর্থ ও মর্ম নিয়ে বিরোধ না থাকা।

৪. কোরআন-সুন্নাহ ও তার মূলনীতির বিরোধী না হওয়া। কোরআন-সুন্নাহবিরোধী যেকোনো প্রথা ও রীতি বাতিল ও বর্জনীয়। (আল-মাদখালুল ফিকহিল আম, পৃষ্ঠা ৮৯৭)

সামাজিক রীতিনীতির প্রকার

১. উরফে কওলি : কথা ও বক্তব্য বিষয়ক প্রচলন। তা হলো সমাজে কোনো শব্দ বা বাক্য নির্ধারিত একটি অর্থে ব্যবহৃত হওয়া। ভিন্ন কোনো অর্থে ব্যবহৃত না হওয়া; এমনকি শব্দ-বাক্য উচ্চারণ করলে শ্রোতার মনে ভিন্ন কোনো অর্থ উপস্থিতও হয় না। যদিও এই শব্দ-বাক্য ভিন্ন অর্থের সম্ভাবনা রাখে। যদি এমন শব্দ-বাক্য ইসলামপূর্ব সময় থেকে প্রচলিত হয় এবং শরিয়ত তার কোনো অর্থ নির্ধারণ করে না দেয়, তবে তার অর্থ নির্ধারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিদের যুগে প্রচলিত অর্থটিই গ্রহণ করতে হবে। আর যদি শব্দ-বাক্যের প্রচলন পরবর্তী সময়ে হয়, তবে উল্লিখিত শর্তের আলোকে তা গ্রহণ করতে হবে।

২. উরফে আমালি : কর্মসূচক প্রথা-প্রচলন। তা হলো কোনো সমাজের মানুষ কোনো কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা। যেমন—সাপ্তাহিক কর্মবিরতি, বিয়ের সময় মহরের নির্ধারিত অংশ পরিশোধ করা, দরদাম না করে হোটেলে খাবার খাওয়া ইত্যাদি।

৩. উরফে আম : জনসাধারণের প্রচলন, যা সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষের ভেতর প্রচলিত। যেমন—বাজারে গিয়ে মুখে মূল্য নির্ধারণ না করে পণ্য গ্রহণ করা এবং নিঃশব্দে মূল্য পরিশোধ করা।

৪. উরফে খাস : বিশেষ শ্রেণির ভেতর প্রচলিত। অর্থাৎ যা নির্ধারিত পেশা ও শ্রেণির মধ্যে প্রচলিত। যেমন—ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি। এ ধরনের প্রচলন বিশেষ শ্রেণির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। অন্যদের ক্ষেত্রে হবে না।

প্রথা-প্রচলন শরিয়তবিরোধী হলে : কোনো সামাজিক নিয়ম, প্রথা, প্রচলন, রীতিনীতি ইসলামী শরিয়তবিরোধী হলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আইন প্রণয়নের সময় তার বিবেচনা করার অবকাশ নেই। সংবিধানবিরোধী প্রথা-প্রচলনের মূল্য সেভাবে সাধারণ আইনে নেই। যেমন—বন্ধকী সম্পত্তি দ্বারা উপকৃত হওয়া সমাজে বহুল প্রচলিত। কিন্তু শরিয়তের দৃষ্টিতে তা সুদের নামান্তর। সুতরাং বহুল প্রচলিত হওয়ার পরও বিষয়টি বৈধতা লাভ করবে না, নিষিদ্ধই থাকবে, যদি না ব্যক্তি তার বৈধতা প্রমাণে কোনো বৈধ কৌশল বা পদ্ধতি অবলম্বন করে।

আল্লাহ সবাইকে ইসলামের পরিপূর্ণ আনুগত্য করার তাওফিক দিন। আমিন।

 

 

কিউটিভি/আয়শা/০৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩/বিকাল ৪:৩২

▎সর্বশেষ

ad