ব্রেকিং নিউজ
কুড়িগ্রামে সেনাবাহিনী’র মাদক বিরোধী অভিযানে ফেনসিডিল, ইয়াবা ও গাঁজাসহ আটক ১ ঢাবি’র জহুরুল হক হল অ্যালামনাই এসোসিয়েশন পুনর্গঠন : সদস্য সচিব নিয়ে বিতর্ক রাস্তায় অভিনেতা সিদ্দিককে মারধরের ভিডিও ভাইরাল ইন্টারপোলের মাধ্যমে হাসিনার বিরুদ্ধে রেড অ্যালার্ট জারির সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাবি দর্শন বিভাগের মানববন্ধন অনুষ্ঠিত ঢাবি দর্শন বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের ১৪তম পুনর্মিলনী ও কমিটি গঠিত হয়েছে সাইদ সোহরাব ও শেখ মো. নাসিম এর নেতৃত্বে ঢাবি মুহসীন হল অ্যালামনাই এসোসিয়েশন গঠন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ডিসপ্লে-তে ভেসে উঠেলো ‘ছাত্রলীগ আবার ভয়ংকর রূপে ফিরবে’ কুড়িগ্রামের উলিপুরে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, যুবদল নেতার মৃত্যু কুড়িগ্রামে নবগঠিত জেলা বিএনপির আহবায়কের বিরুদ্ধে মশাল মিছিল

ব্যাংকক জীবনের উপাখ্যান : পর্ব-৭, সিউলের পথে শূন্য আকাশে

admin | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২২ - ০৪:৩১:৫৪ পিএম

ভোরের আলো আঁধারী ভেদ করে সাড়ে চারশ প্যাসেঞ্জার নিয়ে ডেল্টা’র বিশাল এয়ারক্রাফট আকাশে উড়াল দিল। ব্যাংককের ডনমুয়াং এয়ারপোর্টের আলোঝলমলে রূপ আর কসমোপলিটান শহর ব্যাংকক খুব দ্রুতই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। ডেল্টা এয়ারলাইনসের এই ফ্লাইটটি সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের নারিতা থেকে যাত্রা শুরু করে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, তাইপে ও সিউলের পর একটানা নয় ঘন্টা প্যাসিফিকের উপর দিয়ে শেষ গন্তব্য আমেরিকার ডেট্রয়েটে পৌঁছায়। পৃথিবীর পূর্ব মাথা থেকে একেবারে পশ্চিম মাথায় পৌঁছে যাওয়া।

মাঝ আকাশে প্লেন সমান হয়ে উড়াল দিচ্ছে। টুং করে মিউজিকের সাথে সিটবেল্ট খোলার সাইন দেখতে পেয়ে বেল্ট খুলে রিলাক্স হয়ে বসে পড়লাম। কেবিন ক্রুদের দ্রুত কর্মকান্ড শুরু হল, হট টাওয়েল আর নিউজ পেপার বিলি হচ্ছে। আমি নিলাম ব্যাংকক পোস্ট।

এক কালো এয়ারহোস্টেজ দ্রুত সেলোফেন পেপারে মোড়া হেডফোন দিয়ে গেল। সিটের হাতলে দশটি অডিও চ্যানেলের ফুটা। একটার পর একটাতে ঢুকিয়ে গান চেক করছি। জাপানিজ, চাইনিজ, থাই, কোরিয়ান আরিরাং এবং বাকি চ্যানেলগুলো ইংরেজি গানের। হিন্দি বাংলা গান নেই। মাথার উপরে হ্যান্ড লাগেজ বের করে একটা ক্যাসেট হাতে নিয়ে এয়ার হোস্টেজকে ইশারা করলাম। কাছে আসলে অনুরোধ করলাম, এই ফ্লাইটে আমরা কম পক্ষে ৩০ জন বাংলাদেশী আছি, তোমাদের দশটি অডিও চ্যানেলের একটিতে কি বাংলা গান শুনতে দিবে? আমার আকুতি ভরা আবেদনে এয়ার হোস্টেজ আমার হাত থেকে ক্যাসেটটি নিয়ে হেসে বলল, হোয়াই নট। ওয়েট প্লিজ।

গরম ভাপ উঠছে ব্রেকফাস্টের। খাবার প্যাকেট খোলার সাথেই কন্টিনেন্টাল ব্রেকফাস্টের সাথে বিশাল এক জাম্বো সাইজড বার্গারটা হাতে নিয়ে কামড় দিতে যাব, এরই মাঝে কেমন যেন সন্দেহ হলো। এয়ারহোস্টেজকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি হ্যামবার্গার ? শুওরের মাংস ? এয়ারহোস্টেজ চোখ বড় করে বললেন, ইয়েস। পর্ক। আমি বার্গারটি এয়ারহোস্টেজ এর হাতে দিয়ে বললাম, আমি মুসলিম। শুওরের মাংস আমাদের জন্যে হারাম। এয়ারহোস্টেজ দুঃখ করে বলল, তুমি ভুল করেছ। টিকেট কনফার্মের সময় তোমাকে মুসলিম ফুড উল্লেখ করতে হত। একটু পর কিছু স্লাইসড ব্রেড আর কয়েকটি আনারসের টুকরা আমাকে দিয়ে গেল। আমি খাওয়ার আগে কাছাকাছি যে কজন বাংলাদেশী পেলাম তাদেরকে হ্যামবার্গারের কথা জানিয়ে দিলাম। আমার মত তারাও বার্গার ফেরত দিলেন।

খাওয়া শেষে ফ্লাইট ক্যাপ্টেনের ঘোষণা আসল। আমরা তেত্রিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে যাচ্ছি। আবহাওয়া ভাল। গতানুগতিক ধারাবর্ণনার পর ক্যাপ্টেন বললেন, ব্যাংকক থেকে সিউলের এই ৭ ঘন্টা যাত্রাপথে আপনারা গান শুনতে পারেন। বাংলাদেশী প্যাসেঞ্জারের অনুরোধে চ্যানেল ৮ এ বাংলা গান শুনতে পাবেন। আপনাদের ভ্রমণ আনন্দদায়ক হোক।

খুশিতে মনটা ভরে গেল। হেড ফোনের মাথাটা ঢুকিয়ে দিলাম ৮ নাম্বার ফুটায়। গান বাজছে। সমুদ্র কন্যা শাহনাজ রহমতুল্লাহ’র গান ”সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কোন হাওয়া এনে, তোমার কপালে ছোয়াব গো, ভাবি মনে মনে”।

উইন্ডো সাইড সিটে বসে বাইরে তাকিয়ে আছি। পুরো আকাশ যেন সমুদ্রের নীল জল। হাজার হাজার ফিট নীচে সাদা মেঘ যেন অস্পষ্ঠ ঝাপসা এক দিগন্ত। চোখ বন্ধ আমার। একটার পর একটা গান বাজছে, শাহনাজ রহমাতুল্লাহ যেন মগজের ভিতরে বসে এ গান গাচ্ছে । ”সাগরের সৈকতে, কে যেন দূর হতে, আমারে ধিকি ধিকি চায়, আয় আয় আয় , পারিনাতো তবু যেতে, শিকল বাঁধা এ দুটি পায়”।

এয়ার হোস্টেজের মৃদু ঝাঁকুনিতে ফিরে এলাম বাস্তবে। এয়ারহোস্টেজ বলছে, তুমিতো তোমার কান্ট্রি সং শুনছ, হার্ড ড্রিংক নিবে? মজা পাবে। আমি না বলতেই, সে ওহ সরি, তুমিতো মুসলিম, এলকোহল তোমাদের জন্যে হারাম বলে চলে গেল। একটু পর দেখি, এয়ার হোস্টেজ অনতি দূরে বসা এক বাংলাদেশিকে সিভার্স রিগাল হুইস্কির কয়েকটি ছোট ছোট বোতল দিয়ে গেল। ফিরে যাওয়ার সময় আমারে খোচাঁ মারল একটা। হ্যায়, পর্ক ইজ হারাম ফর মুসলিম বাট হুইস্কি ইজ হালাল। হা হা হা। আমি এয়ার হোস্টেজের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, ঠিকইতো, শুওরের মাংস হারাম বলে ফিরিয়ে দেয়া আমার মুসলিম ভাইরা দেদারসে মদ গিলছে।

টানা তিন ঘন্টা আকাশে উড়ে ডেল্টা এয়ারলাইনসের এই ফ্লাইট তাইপে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে। এখানে এক ঘন্টার বিরতি। ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার নামবে ও উঠবে। মজার বিষয় ল্যান্ড করার আগে পাক্কা পনের মিনিট আকাশে স্থীর দাঁড়িয়ে থাকল এয়ারক্রাফট। রানওয়েতে হেভি ট্রাফিক। ল্যান্ডিং এর অনুমতি পাচ্ছেনা কন্ট্রোলরুম থেকে ।

আবারো নীলাকাশ। আবারো শাহনাজ রহমতুল্লাহর গান। লাঞ্চ সার্ভ করে গেছে এয়ার হোস্টেজ। আমিতো আমার গল্প বলেছি, তুমি কেন কাঁদলে? আমিতো আমার আগুনে জ্বলেছি, তুমি কেন কাঁদলে ? আহ, আমি ভুলে গিয়েছি, আমি যাচ্ছি এক অজানা গন্তব্যে। যেখানে আমার অনাগত ভবিষ্যৎ। কিছুই জানিনা আমি আমার আগামী দিন। আমার চোখের কোন বেয়ে পানি ঝরছে। একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়— চোখে ভাসছে আমার গ্রাম, আমার দেশ আমার হারানো ক্যাম্পাস।

ফেলে আসা ব্যাংককের কথা মনে পড়ছে। বড়ভাই, সাঈদ,অশোক, দুলাল ভাই, ভাবী, বান্টি,সনিকার কথা মনে পড়ছে। ফেলে আসা ক্যাম্পাসের কথা মনে পড়ছে। আনন্দ বেদনার কাব্যময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। আহা কি সোনালী একটা অতীত ছিল আমাদের ! চোখ ভিজে আসে আমার।

শেষ বিকেলে সিউলের কিম্পু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ডেল্টার চাকা স্পর্শ করল। ইমিগ্রেশন শেষ করে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আসলাম। ডিসেম্বর মাস। শূন্যের সাত ডিগ্রি নীচে তাপমাত্রা সিউলে। শরীরে ধাক্কা মারল সুঁচ ফুটানো কনকনে বাতাস। সারা শরীরে একমাত্র খোলা চোখ আর মুখে তুষার ঝরে পরে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমাকে নিতে এসেছে আমিন ভাই। তার সারা শরীর ওভারকোটে মোড়া। উনি আমাকে নিয়ে উঠে পড়লেন লিমোজিন বাসে। শুকনো পাহাড়, পত্রপল্লবহীন গাছ, সব কিছুই তুষারে মোড়া। সাদা তুলার মত তুষার গাছের ডাল পালাগুলোতে ঝুলে আছে। লিমোজিন বাস থেকে সে দৃশ্য দেখে বুকটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে।

ছবিঃ ১. ডেল্টা এয়ারলাইন্স এর উড়ন্ত বোয়িং। ২.শাহনাজ রহমতুল্লাহ। ৩. তাইপে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, তাইওয়ান ৪. কিম্পু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া ।

লেখকঃ লুৎফর রহমান। লেখক, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ।

 

বিপুল/১৭ই এপ্রিল, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ | বিকাল ৪:২৪

▎সর্বশেষ

ad