আমরা ৬ জন। ব্যাংককের ডাউনটাউন ফাওরাতের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াই। সামান্য একটু দূরে মেরিকিংস মার্কেট। এটিএম মার্কেটের চেয়ে কয়েকগুন বড় মেরিকিংস। মাঝে মাঝে আমাদের আড্ডাস্থল হল মেরিকিংস।এখানে আমরা কফি খাই। বাংলাদেশের ধনিক শ্রেণীর স্ত্রীরা এই মার্কেটে বেশি কেনাকাটা করে। এখানে প্রচুর সিঙ্গাপুরি শাড়ী পাওয়া যায়।
আমাদের ৬ জনের ৫ জনই আমরা বন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একই ইয়ারের ছাত্র ছিলাম। রাজনৈতিক পদবিতেও প্রায় সমপর্যায়ের। সাঈদ সোহরাব মুহসিন হল ছাত্র সংসদের জিএস, সজল একই হল সংসদের এজিএস এবং হল শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক, জুয়েল সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক, আমি জহুরুল হক হল শাখার সাধারণ সম্পাদক, অশোক জগন্নাথ হল শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম-আহবায়ক। শুধুমাত্র বড়ভাই ছিলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকীয় পদে।
ব্যাংককে আমরা একই সময়ে আসলেও আমাদের আগমনের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চলে যায় ইলিয়াস আলীর হাতে। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় আহবায়ক,ডাকসুর ভিপি তখন এমপি নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের অপেক্ষায়। ছাত্রদলের রাজনীতিতে সঙ্গত কারণে তার সময় দেয়ার সুযোগ ছিলনা। ইলিয়াস আলী এই সুযোগের পূর্ণাঙ্গ সদ্যবহার করেন। পরবর্তীতে ইলিয়াস গ্ৰুপের অভ্যন্তরে নতুন একটি গ্ৰুপের সৃষ্টি হয়। এই গ্ৰুপের শীর্ষ নেতৃত্বের একজন ছিল সাঈদ সোহরাব। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের একপর্যায়ে সাঈদ ও অশোককে দেশ ছাড়তে হয়।
এরশাদ পদত্যাগ করার পূর্বেই ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সংগঠন থেকে বহিস্কার হয় বড়ভাই সহ সজল, জুয়েল সহ আরও অনেকেই। একদা স্বৈরাচার এরশাদের জন্য যারা চরম দুঃচিন্তার কারণ ছিলেন তারাই ছাত্র রাজনীতির জটিল প্যাচে পরে জাতির কাছে ভিলেনে পরিণত হলেন। রাষ্ট্র তাদের নিষিদ্ধ করল। তাদের ছবি সম্বলিত পোস্টার ছেয়ে গেল সারাদেশে। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রচারিত এ পোস্টারে তাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দেয়া হল।
বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বড়ভাইয়ের নেতৃত্বের গ্ৰুপটি সঙ্গত কারণে কোনঠাসা হয়ে পরে। তারপরেও তারা হাল ছাড়েনি। রাষ্ট্রীয় চাপের মুখেও তারা ছিল সুসংগঠিত। কিন্তু ৯১ সালের ২৭শে অক্টোবর রোকেয়া হলের সামনে বন্দুক যুদ্ধে দুজন নিহত হওয়ার পর আর তাদের পক্ষে দেশে থাকা সম্ভব হয়নি। ব্যাংককে আসতে হয় তাদেরকে। আমি ছিলাম বরাবরই ইলিয়াস গ্ৰুপের বিপক্ষে। এরশাদের সময় ও পরবর্তীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরেও তারা ছিল আমার কাছে মানসিক ভাবে বিরুদ্ধপক্ষ। বিএনপি ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পরে ইলিয়াস গ্ৰুপের কয়েকজন বিএনপির ২৭ নম্বরের দলীয় কার্যালয়ে ওরা আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে দেয়।
ব্যাংককে আমরা আছি সজল জুয়েলরা জানত। কিন্তু কোথায় আছি সেটা জানতনা। ডনমুয়াং এয়ারপোর্ট থেকে সজল জুয়েলরা উঠল ব্যাংককে ”লিটল চায়না” খ্যাত জাওরাতের নিউ এম্পোরিয়াম হোটেলে। এরপরে আমাদের খোঁজ পেয়ে চলে আসে ব্যাংককের ”লিটল ইন্ডিয়া” খ্যাত ফাওরাতে। সজল জুয়েল আসার ৩ দিন পর বড়ভাই আসেন। সরাসরি ফাওরাতেই।
দুলাল ভাই আমাদের ভালো রাখার চেষ্টা করেন। দুলাল ভাইয়ের শশুর পক্ষের অনেক আত্মীয় স্বজন ব্যাংককে। তাদের কারো জন্মদিন, কারো বিয়ে অথবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দুলাল ভাই আমাদের নিয়ে যান। আমরা হৈ হুল্লোড়ের এক নতুন জীবনে প্রবেশ করি। আস্তে আস্তে কসমোপলিটান ব্যাংককের জীবনের সাথে আমরা মিশে যেতে থাকি। পিছনে ধূসর স্মৃতি হয়ে পরে থাকে আমাদের বর্ণাঢ্য ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস।
সন্ধ্যা হলেই প্রতিদিন ডিনার পার্টি থাকে। ব্যাংককে স্থায়ীভাবে কিছু আদম ব্যবসায়ী থাকে। এরা আমাদের সানিধ্য প্রত্যাশা করে। আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। যেদিন কোন আদম ব্যাপারীর আদম জাপান বা আমেরিকা ঢুকতে পারে সেদিন তাদের যেন ঈদ উৎসব শুরু হয়। এই আনন্দে পার্টি দেয়। দুলাল ভাই সহ সে পার্টিতে আমরা যাই। ডিনার করি। ডিনার পার্টি মানে রঙ্গিন পানীয় এর ছড়াছড়ি। আমাদের দৌড় কোক আর স্প্রাইট পর্যন্ত । একদিন কে যেন একজন দুস্টুমি করে কোকের সঙ্গে সামান্য সিভাস রিগ্যাল মিশিয়ে বড়ভাইকে দিয়েছিল। বড় ভাই গ্লাসে চুমুক দিয়েই শুরু করলেন ওয়াক ওয়াক করে বমি। কে এই ফাজলামো করল ? দুলাল ভাই গেলেন ক্ষেপে। বড়ভাই একটু পরে প্রকৃতিস্থ হয়ে বললেন, আমি জীবনে একটা সিগারেটেও টান দেইনি। এ কাজটি কে করেছে ? বাংলাদেশ হলে এর জবাব দিতাম হাজার রাউন্ড বুলেট দিয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যাদের নেতৃত্বে রাজনীতি করেছি তাদের ব্যক্তিগত জীবন ছিল পরিচ্ছন্ন। কিংবদন্তির ছাত্রনেতা সানাউল হক নীরু ছিলেন আমাদের এরকম এক জন বড়ভাই, এরকম একজন নেতা । কোনোদিন সিগারেট পর্যন্ত খাননি। চায়ের দোকানে আড্ডা দেননি। অনৈতিক কোন অভ্যেস ছিলনা তাদের। বড়ভাইকেও ক্যাম্পাসে কোনোদিন কোন নেশার সংগে জড়িত থাকতে দেখিনি। আমাদের জীবনে ছাত্র রাজনীতিই ছিল আমাদের মোহ, আমাদের আকর্ষণ, আমাদের নেশা।
ছবিঃ ১. কসমোপলিটান ব্যাংকক শহরের রাতের দৃশ্য। ২. ব্যাংককে বান্টি ফটোপ্রিন্ট ও বান্টি ট্রাভেলস এর স্বত্বাধিকারী ইসতিয়াক আহমেদ দুলাল। ৩. ঢাবির মুহসিন হল ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস গাজী কামরুল ইসলাম সজল। ৪. কিংবদন্তীর ছাত্রনেতা বাবলু -নীরু সহোদর।
লেখকঃ লেখকঃ লুৎফর রহমান। লেখক, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ।
কিউএনবি/বিপুল/১০ই এপ্রিল, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ | বিকাল ৩.২০