
“গাঁতা” নিয়ে আমার ব্যাথা
——————————–
গাঁতা শব্দটি অনেকের কাছেই অপরিচিত। এর শাব্দিক রুপ একটু ভিন্ন। তিন চার দশক পুর্বে গাঁতা কর্মটি বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে পরিলক্ষিত হত। এই গাঁতা নিয়ে এক ব্যাথাতুর কাহিনী জড়িয়ে আছে আমার জীবনে।
গাঁতা শব্দটির মর্মার্থ লিখতে গিয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে পেলাম, “রীতি বিশেষ কৃষকগন কর্তৃক বিপন্ন কৃষক গনের কাজ বিনা মজুরীতে সম্পাদন “। মুল বিষয়টি কাছাকাছি হলেও গাঁতা বিষয়টি সমবায় ভিত্তিক কৃষিকাজ সম্পন্ন করাই বুঝায়।
একদা রংপুর অঞ্চলে বছরে দুটি মওশুম ছিল। আউশ আর আমন মৌসুম। আউশধান ক্ষরা মৌশুমে জমি চাষ করে ধান বীজ ছিটিয়ে দেয়া হয়। সেই বীজ থেকে ধানের চারা গজিয়ে উঠলে আগাছা বা ঘাষ নিড়ানি দিতে হয়। একই সময় পাটের বীজও বপন করা হয়। সেখানেও ঘাস নিড়ানির আবশ্যকতা দেখা দেয়।
এই নিড়ানির কাজকে সহজ করার জন্যে গাঁতা সিস্টেম চালু করেন কৃষকগন। জমির মালিক এবং দিনমজুরগন সমবায় ভিত্তিক আজ একজনের নিড়ানি দেয়তো কাল আরেক জনের। এভাবেই ধান পাট মৌসুমের প্রথম নিড়ানির কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা হয়। পালাক্রমে অংশগ্রহনরত কৃষক ও দিনমজুরগনের এই পদ্ধতিকে গাঁতা বলে।
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে গাঁতা পদ্ধতিতে আমাদের জমিতে নিড়ানির কাজ চলত। আমাদের জমির পরিমান বেশি বিধায় গাঁতায় আমাদের পক্ষ থেকে কয়েকজন দিনমজুর কাজ করত।
যেদিন এই গাঁতা আমাদের জমিতে নিড়ানি দিত সেদিন কৃষক সহ দিনমজুরদের দুপুরের খাবার সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব থাকত আমি সহ আমাদের বাড়ির ২/৩ জনের উপর।
গরম কালে ৪ ঘন্টার স্কুল। ভর দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি এসে নিজেরা খেয়ে দেয়ে গাঁতার জন্যে খাবার নিয়ে যেতাম আমরা। বড় বড় গামলায় ভাত বা পান্তাভাত, খোসা সহ মশুর ডালের ভর্তা, সবজি ভাজি ইত্যাদি ছিল খাবার মেন্যু।
একদিন খাবার পাঠানোর দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু স্কুল থেকে বাড়িতে এসে নিজেরা খাওয়া শেষ করেছি মাত্র। এমন সময় চারিদিকে হইচই শুরু হয়ে গেল। বাড়ীর বাইরে এসে দেখি ” দি রওশন সার্কাস” এর দুটি হাতি এসেছে আমাদের গ্রামে। এই হাতি নিয়ে হইচই সাড়া গ্রামে।
বাড়ির আশে পাশে কলাগাছ দুমড়ে মুচড়ে হাতি এগিয়ে যাচ্ছে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এক পাড়া থেকে আরেক পাড়া, এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম।
গাঁতায় খাবার পাঠানোর কথা ভুলেছি তখন। আমি সহ আমার বাড়ি থেকে খাবার পাঠানোর সংগি ২/৩ জনও ছুটছি হাতির পিছনে। হাতি হেটে যায় আর হাতির সংগে তাল মিলাতে গিয়ে আমাদের দৌড়াতে হচ্ছে। এভাবেই মাইলের পর মাইল ছুটে চলেছি হাতির পিছনে।
হাতি দেখার পুর্ন সখ মিটিয়ে যখন বাড়ি ফিরেছি তখন বেলা ডুবে যাচ্ছে যাচ্ছে অবস্থা। গাঁতায় খাবার পাঠাইনি এই ভয়ে আমরা কুকড়ে আছি। দিনমজুর গন যখন আমার বাবার কাছে টাকা নিচ্ছে তখন তাদের ক্ষুধার্ত চাহনী আর পিঠের সংগে পেট মিশে যাওয়া দৃশ্য দেখে আমার সেই কিশোর হৃদয়েও হাহাকার করা কস্টবোধ সৃস্টি হল। আহারে চৈত্রের খরতাপে লোকগুলো সারাদিন না খাওয়া ছিল।
প্রায় ৪০ বছর পুর্বের এই দৃশ্যটি এখনো আমাকে নাড়া দেয়, কস্ট দেয়, নিদারুন এক ব্যাথার সৃস্টি করে। আমি আমার অতিত জীবনের ভালমন্দ, পাপ পুন্যে নিয়ে ভাবি। একটি অন্যায়, একটি পাপ কাজের তালিকায় আমার কারনে কতগুলো লোকের বুভুক্ষতা সৃস্টির জন্যে এই বিষয়ে নিজেকে দায়ী করি। আমি আমার নিজেকেই আজ পর্যন্ত এই অপরাধ থেকে দ্বায়মুক্তি দিতে পারিনি।
গাঁতা প্রথা এখন নেই। কিন্তু গাঁতাকে কেন্দ্র করে আজও আমি আমার এই অপরাধ, এই কস্ট, এই ব্যাথা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। মাঝে মাঝেই এই ছোট ঘটনাটি আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলে।
লেখকঃ লুৎফর রহমান।
বিপুল/০৫.১২.২০২২/ দুপুর ১২.৫৩