৪ঠা চৈত্র ১৮ই মার্চ, রোজ রবিবার, ১৯৭৩ সালের এই দিনে বিকাল ৫.৪৫ মিনিটে আমার মা মারা গেলেন। আজ থেকে ৪৯ বছর আগে আমার মা এর চলে যাওয়া সে শুধু কেবলি এক ধূসর স্মৃতি। প্রতি বছর এ দিনটি আসে আমার জীবনে এক সাগর ব্যাথা নিয়ে।
আমার নিতান্তই শিশু অবস্থায় আমার মা আমাকে ফেলে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আমার পৃথিবী বদলাতে শুরু করল। অন্য এক অজানা জগতে আমি প্রবেশ করলাম। মা বিহীন আমার জীবন, সে শুধু চুপি চুপি ফুঁপিয়ে কান্নার এক জীবন।
আমার বয়স বাড়ছে। আমাকে স্কুলে দেয়া হল। পাড়ার সব ছেলে মেয়ে সহ দলবেঁধে একমাইল দূরে স্কুলে যাই। স্কুলের পড়া, খেলাধুলা, আর ছুটির ঘন্টা বাজলে স্কুলের পাশে বাঁশ বাগানের ছাঁয়ায় নামতা পড়ি। দুই এক্কে দুই, দুই দুগুনে চার, তিন দুগুনে ছয়। সুর করে নামতাপড়া শেষ হলে আবারও দলবেঁধে বাড়ী ফিরি। চৈত্রের প্রচন্ড গরম আর চোয়ালে সূর্যের তির্যক রশ্মি বই দিয়ে ডেকে ক্লান্ত হতদ্বন্দ্ব হয়ে আমার ঘরে ফেরা।
স্কুল থেকে বাড়ী ফেরার অর্ধেক রাস্তায় জামালের বাড়ী। জামালের মা ছেলের জন্যে আঙ্গিনায় অপেক্ষায় করছে। জামালকে কাছে পেয়ে জামালের মা পরম মমতায় জামালের ঘর্মাক্ত মুখ আঁচলে মুছে দেয়। আমি সে দৃশ্য সরাসরি তাকাতে পারিনা। আমি মুখ ঘুরিয়ে পথ চলি, আমার চোখের পানি মুখের ঘামে মিশে গড়িয়ে পরে। আমার মা নেই, আমার মুখের ঘাম মুছিয়ে দেয়ার কোন আঁচল নেই।
বাড়ি ফিরি, একা একা হাত মুখ ধুই। পাশের বাড়ীর রফিকুলকে ওর মা চিরুনী দিয়ে মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছে। আমি সে দৃশ্য দেখি। আমার মা নেই, আমার মাথায় চিরুনি দেয়ার কেউ নেই। আমি আমার সংগোপনের অশ্রুধারা হাত দিয়ে মুছে ফেলি। এরপরে একা একা ভাত খাই। খাওয়ার পরে মায়ের শূন্য বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। বুকের মধ্যে যেন কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করি।
বিকালে মাঠে খেলতে যাই। খেলতে খেলতে কুদ্দুসের সঙ্গে মারামারি লেগে যায়। কুদ্দুস আমার হাতে মার্ খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওর মায়ের কাছে নালিশ করে। কুদ্দুসের মা কোমর বেঁধে ছেলের হাত ধরে আমাদের বাড়ী এসে মাত করে তুলে,ঝগড়া করে। আমার বিরুদ্ধে সকলকে নালিশ করে। আমি চুপ করে থাকি আর ভাবি, আমি যেদিন মার খাই, সেদিনতো আমার পক্ষে কেউ কোমর বেঁধে নামে না? নিজেকে নিজেই শান্তনা দেই, আমার যে হাত ধরার কেউ নেই। আমার মা নেই।
শেষ বিকালে পদ্মা মাঝিয়ানি মাথায় ডালি নিয়ে শুঁটকি, মোয়া, গজা ফেরি করতে আসে। আমাকে দেখলে মাথার ডালি নামিয়ে আমাকে কোলে বসায়। আমার নানা বাড়ীর কাছে পদ্মা মাঝিয়ানির বাড়ী। আমার মায়ের ছোট বেলার বান্ধবী। পদ্মা মাঝিয়ানি আমার হাতে মোয়া তুলে দেয়। আমি মোয়ার মধ্যে কামড় দেই। অজান্তে আমার চোখে পানি আসে। পদ্মা মাঝিয়ানির মাঝে আমি আমার মাকে খুঁজি।
রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। স্বপ্নে দেখি মা’কে জড়িয়ে আমি শুয়ে আছি। কিছুক্ষন পর আমার হাতে একটা শক্ত শরীরের স্পর্শ পাই। নিমিষে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এ শরীর আমার মায়ের নয়। এই শক্ত শরীরটা আমার বাবার। আমি আমার বাবাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার অবচেতন মন স্বপ্নে মা এর স্পর্শ খুঁজেছিল। বাস্তবে এটি আমার বাবার শরীর। আমি পাশ ফিরে ঘুমের ভাণ করি। আমার চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যায়।
৪৯ বছর পার হয়ে গেছে। এখনো আমি মা’কে খুঁজে ফিরি। আমার বন্ধুরা তাদের মা’কে নিয়ে হাসপাতালে চেক আপে যায়, ওমরাহ হজ্জ করতে মক্কা মদিনা যায়। আমার মা নেই। মা’কে নিয়ে আমার হাসপাতালেও যাওয়া হয়না। ওমরাহ হজ করতে মক্কা মদিনায়ও যাওয়া হয়না। মা বিহীন আমার জীবন চোখের পানিতে ভাসমান এক ভেলার জীবন। ছন্নছাড়া এক বাউন্ডুলে জীবন।
পাদটীকাঃ বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে জেলে সম্প্রদায়ের নারীরা ”মাঝিয়ানি” পেশার সঙ্গে জড়িত। যারা মাছ ধরে, মাছ কিনে বাজারে বিক্রি করে তাদেরকে জেলে না বলে ”মাঝি” বলা হয়। তাদের কন্যা জায়া জননীরা ডালিতে করে শুঁটকি মাছ, মোয়া,গজা, মুড়কি,শুকনা মিষ্টান্ন ফেরি করে বিক্রি করে। এদের আরেকটি পেশা, ধাত্রীর কাজ করা। প্রসূতি মায়ের সন্তান প্রসবে ধাত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ন হওয়া। আমার জন্মেও এমন এক ধাত্রীমা, দাইমার ভূমিকা ছিল।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। লেখক,কলামিস্ট,রাজনীতিবিদ।
বিপুল/১৬ই এপ্রিল, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ | রাত ১২:৫১