আন্তর্জাতিক ডেস্ক : লেবাননে ইসরাইলের স্থল অভিযানের দ্বিতীয় সপ্তাহ শেষের পথে এবং একইসঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ জড়ানোও দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করলো। বৃহস্পতিবার বৈরুতের বিমান হামলার পর যুদ্ধবিরতির অনুরোধ জোরালো হচ্ছে। দক্ষিণ লেবাননে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের ওপর দ্বিতীয় দিনের মতো হামলা করেছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে দামেস্ক থেকে রাতের একটি ফ্লাইটে বাগদাদে এসেছিলেন ইরানের জেনারেল কাশেম সোলাইমানি। তিনি ইরানের এলিট বাহিনী কুদস ফোর্সের প্রধান ছিলেন। এটি মূলত ইরানের রিভল্যিউশনারী গার্ডের গোপন ইউনিট। এই গ্রুপটির নামের অর্থ জেরুসালেম এবং তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ইসরাইল। ইরাকে, লেবাননে, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ও অন্যত্র অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ ও সরাসরি ছায়া বাহিনী হিসেবে কাজ করে তারা। ওই সময় সোলাইমানি ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনীর পর ইরানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান মানুষ।
সোলাইমানির গাড়ি বহর বিমানবন্দর ছাড়া মাত্রই ড্রোন থেকে ছোড়া মিসাইলে তিনি নিহত হন। যদিও ইসরাইল তার প্রতিপক্ষের অবস্থান চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছে, তারপরেও ড্রোনটি ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের। ওই হত্যাকাণ্ডের অনুমোদন দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নন।
পরে এক বক্তৃতায় সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন তিনি কখনোই ভুলবেন না যে নেতানিয়াহু তাদের হতাশ করেছিলেন।আরেকটি ইন্টারভিউতে তিনি বলেছেন যে ওই ঘটনায় তিনি ইসরাইলের আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছিলেন এবং অভিযোগ করেছিলেন যে নেতানিয়াহু চাইছিলেন যে ‘আমেরিকা তার শেষ সৈন্য পর্যন্ত ইরানের বিরুদ্ধে লড়াই করুক’।
নেতানিয়াহু ওই হত্যাকাণ্ডের প্রশংসা করেছিলেন। তবে ওই সময় এটা মনে করা হতো যে, তার উদ্বেগ ছিলো এই যে ইসরাইল সরাসরি জড়িত হলে এটা সরাসরি ইরান কিংবা লেবানন ও ফিলিস্তিন থেকে ইসরাইলে বড় ধরণের হামলার কারণ হতে পারে।
ইসরাইল ইরানের বিরুদ্ধে ছায়া যুদ্ধে জড়িত ছিলো কিন্তু উভয়পক্ষই সতর্ক ছিলো যাতে তাদের লড়াই একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে। বড় সংঘাতে জড়িত পড়ার উস্কানি হতে পারে-এমন ভয় থেকেই এটা হতো।
চার বছর পর চলতি বছর এপ্রিলে সেই একই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দামেস্কে ইরানের কূটনৈতিক কম্পাউণ্ডে বোমা হামলার নির্দেশ দিলেন, যেখানে নিহতদের মধ্যে দুজন ইরানি জেনারেলও ছিলেন।
এরপর জুলাইয়ে বৈরুতে বিমান হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার ফুয়াদ শুকর হত্যার অনুমোদন দেন তিনি। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাতে হতভম্ব হয়েছিলেন বলে বব উডওয়ার্ডের নতুন এক বইয়ে দাবি করা হয়েছে। এখানে হতভম্ব হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী সংঘাত বাড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন যা হোয়াইট হাউজ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছিলো।
ইসরাইল সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী যে ধারণা তৈরি হচ্ছে তা হলো ‘তুমি একটা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র, একজন দুর্বৃত্ত খেলোয়াড়’। একই প্রধানমন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট চিহ্নিত করলেন অত্যন্ত সতর্ক হিসেবে আর তার উত্তরসূরি চিহ্নিত করলেন আগ্রাসী হিসেবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত দিন এবং একটি রাজনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিপর্যয়কর দিন। এ দুটি বিষয়ই ইসরাইলকে চলমান যুদ্ধে জড়িত হতে সহায়তা করে।
ইসরাইলে হামাসের হামলার মাত্রা ও ব্যাপকতা ইসরাইলি সমাজ ও এর নিরাপত্তাবোধের ওপর প্রভাব ফেলেছে, যে কারণে এবারের যুদ্ধ সাম্প্রতিক সব সংঘাতের চেয়ে আলাদা।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিচ্ছে ইসরাইলকে। আবার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু ও গাজার দুর্ভোগ তাদের জন্য অস্বস্তির ও রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর।
এপ্রিলে ইসরাইলে ইরানের হামলার ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানও সক্রিয় ছিলো। এটি একটি পরিষ্কার প্রমাণ যে ইসরাইলের নিরাপত্তা বিষয়ে তার সবচেয়ে বড় সহযোগী কতটা ভূমিকা রাখে।
এই গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব অনুমোদন ছাড়াই ইসরাইল হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
ইসরাইলের দীর্ঘসময়ের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বিশ বছরের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছেন যে উপেক্ষা না করলেও, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সামলানো যায়।
নেতানিয়াহু জানেন যে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে তাদের বর্তমান নির্বাচনের বছরে তাকে তার পথ থেকে সরাতে চাপ দিবে না এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে তিনি আমেরিকার শত্রুর বিরুদ্ধেও লড়ছেন।
এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, নেতানিয়াহু ইসরাইলের রাজনৈতিক মূলধারার বাইরে গিয়ে কাজ করছেন। সেজন্য হিজবুল্লাহর ওপর শক্ত আঘাত হানার চাপ বাড়তে পারে, এমনকি ইরানের বিরুদ্ধেও।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স যখন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছিলো তখন ইসরাইলের বিরোধ ও প্রধান বাম ও ডান ধারা থেকে একুশ দিনের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরোধিতা সমালোচনা আসলো।
ইসরাইল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।এর কারণ শুধু এটা নয় যে তারা আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলায় সক্ষম, বরং ৭ অক্টোবরের পর নিজের হুমকিগুলোর প্রতি সহনশীলতার নীতি পাল্টে গেছে।
হিজবুল্লাহ দীর্ঘকাল ধরেই ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলের গালিলীতে আগ্রাসন করতে চাইছে। এখন ইসরাইলের মানুষের ঘরে বন্দুকধারীর হামলার অভিজ্ঞতা হলো। সে কারণে তারা মনে করলে এই হুমকি উপড়ে ফেলতে হবে।
ঝুঁকি বিষয়ে ইসরাইলের ধারণাও পাল্টে গেছে। ওই অঞ্চলের দীর্ঘদিনের সামরিক সীমারেখা হারিয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে এমন অনেক কিছু ঘটেছে যা সর্বাত্মক সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আছে তেহরান, বৈরুতে, তেল আবিব ও জেরুসালেম বৃষ্টির মতো বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা।
ইসরাইল হামাস প্রধানকে হত্যা করেছে, যখন তিনি তেহরানে ইরানের অতিথি ছিলেন। তারা হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ পুরো নেতৃত্বকে ধ্বংস করেছে। সিরিয়ায় কূটনৈতিক ভবনে দুজন ইরানি কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে।
হিজবুল্লাহ নয় হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও ড্রোন ছুড়েছে ইসরাইলের শহরগুলো লক্ষ্য করে। তেল আবিবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুতিরাও বড় ধরণের হামলা চালিয়েছে।
ইরানও গত ছয় মাসে দুবার হামলা করেছে যাতে পাঁচশর বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ইসরাইল লেবাননে আগ্রাসন চালিয়েছে।
এবং এর কোন একটিই হয়তো ওই অঞ্চলকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে এবং সত্যি হলো ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীও এসব বিষয়ে কোন ঝুঁকি না নিয়েই তার পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা
কিউটিভি/আয়শা/১২ অক্টোবর ২০২৪,/রাত ৯:০০