ডেস্ক নিউজ : রমজান ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মাস। তবে রমজানে মুসলমানের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড শুধু ইবাদত-বন্দেগিতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তাতে বহুমুখী সংস্কৃতির চর্চা হয়ে থাকে। বস্তুত রমজান মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় জাগরণের মাসে পরিণত হয়।
রমজানে বহুমুখী ধর্মীয় কর্মকাণ্ড
পবিত্র রমজান কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্বে যে ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তা কোন যুগে কেমন ছিল তুলে ধরা হলো।
১. ইবাদতমুখর রমজান : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সাহাবিরা ইবাদতমুখর রমজান কাটাতেন। তাঁরা তাহাজ্জুদ, কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া ও জিকিরে মগ্ন রাত কাটাতেন, বিশেষত কদরের রাতে তাঁরা মসজিদে সমবেত হয়ে কোরআন তিলাওয়াত করতেন এবং ফজর পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন। খুলাফায়ে রাশেদার যুগের দৃশ্যও অনেকটা অনুরূপ ছিল।
২. কবিতায় আল্লাহর মহিমা : উমাইয়া খলিফারা ছিল সাহিত্যানুরাগী।তাঁরা সাধারণ ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি রমজানের রাতে কবিতা পাঠ ও সাহিত্যের আসরের প্রচলন করেন, যা আব্বাসীয় যুগে আরো প্রসার লাভ করে। বিশেষত খলিফা হারুনুর রশিদ ও মামুন সাহিত্য আসরকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। এসব আসরে সাধারণত সেসব কবিতাই পাঠ করা হতো, যাতে আল্লাহ, রাসুল, ইসলাম ও পূর্বসূরি মনীষীদের প্রশংসা করা হতো।
৩. অসহায়ের জন্য উন্মুক্ত দরজা : মামলুক শাসক আহমদ ইবনে তুলুন তাঁর রাজত্বের চতুর্থ বছর প্রথম রমজানে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের, সামরিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের একটি সভায় ডেকে পাঠান।
তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাদের এই সভায় এ জন্য ডেকে এনেছি যে আমি আপনাদের মানুষের প্রতি সদাচরণ শিক্ষা দিতে চাই। আমি জানি, আমি আপনাদের সম্মানে যে খাবার ও পানীয় প্রস্তুত করেছি আপনাদের তা প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি দেখলাম, রমজানে মানুষের প্রতি সদাচার করার যে দায়িত্ব আপনাদের ওপর অর্পিত হয়েছে সে ব্যাপারে আপনারা উদাসীন। আমি আপনাদের নির্দেশ করছি যে আপনারা আপনাদের ঘর ও দস্তরখান উন্মুক্ত করে দেবেন। আপনারা নিজেদের জন্য যা পছন্দ করেন অসহায় ও বঞ্চিত মানুষকে তার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ করে দেবেন।
এর পর থেকে প্রতিবছর তিনি রমজানের শুরুতে এভাবে ডেকে পাঠাতেন এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণিকে উপদেশ দিতেন। ফলে তাঁর শাসনাধীন শাম ও মিসরের বিস্তৃত অঞ্চলে রমজানে দান, সদকা ও সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
৪. তিলাওয়াত ও সংগীত : মিসরের মুসলিমরা রমজানের দিনে মসজিদে দ্বিনি শিক্ষার আসর করে এবং দিনের দীর্ঘ সময় মসজিদে ইবাদত ও তিলাওয়াতে কাটাতে পছন্দ করে। রাতে হয় বিভিন্ন ধর্মীয় সভা। সন্ধ্যায় তারা সম্মিলিত ইফতার আয়োজনে অংশ নেয় এবং ধর্মীয় সংগীত গায়। ফকিহ লাইস বিন সাআদ (রহ.) মিসরে উন্মুক্ত ইফতারের প্রচলন ঘটান। তিনি শীতকালে মধু ও ঘি দিয়ে এবং গ্রীষ্মকালে বাদাম ও চিনি দিয়ে শরবত তৈরি করতেন।
৫. জ্ঞানচর্চা ও বিতর্ক : রমজানে তুর্কি আলেমদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্ক ছিল একটি রাজকীয় আয়োজন। তুর্কি রমজানে ধর্মীয় আলোচনার রীতি—যা হুজুরে হুমায়ুন ওয়াজ নামে পরিচিত, এটি বেশ পুরনো হলেও তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে। রমজানে সুলতানের উপস্থিতিতে প্রাজ্ঞ আলেমরা কোরআনের ব্যাখ্যা করতেন। এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করত ছাত্র ও সাধারণ মানুষ। তারা প্রশ্ন করারও সুযোগ পেত।
বার্ষিক এই আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হতো ইস্তাম্বুলে অবস্থিত উসমানীয় সুলতানের বাসভবন কোপকাপি প্রাসাদে। ১৯২৪ সালে উসমানীয় খিলাফতের অবসান ঘটার আগ পর্যন্ত ১৬৫ বছর পর্যন্ত এই আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
৬. উন্মুক্ত ইফতার : ফাতেমি সুলতানরা ‘মাওয়াইদুর রহমান’ (আল্লাহর দস্তরখান) নামে উন্মুক্ত ইফতারের ব্যবস্থা করতেন। যেগুলো পরিচালনার জন্য ‘দারুল ফিতরা’ নামে পৃথক বিভাগ ছিল। খলিফা আজিজ বিল্লাহর সময় উন্মুক্ত দস্তরখানের দৈর্ঘ্য ১৭৫ মিটারে উন্নীত হয়, যা প্রস্থে ছিল ৪ মিটার। উজির ইবনুল ফুরাত প্রতিবছর রমজানে লাখ লাখ স্বর্ণ মুদ্রা ব্যয় করতেন। রমজানে তাঁর আয়োজিত ইফতারের দস্তরখানের দৈর্ঘ্য ছিল পাঁচ শ মিটার। এই দস্তরখানের সম্মুখভাগে (প্রস্থে) ৩০ জন বসতে পারত।
৭. গোশত বিতরণ : সুলতান হাসান রমজানে প্রতিদিন ১১৭টি পশু জবাই করে তা মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন। তিনি তাঁর ১৭ বছর বয়সে প্রথমে ১৭টি পশু জবাই করতেন। ধীরে ধীরে তা ১১৭টিতে উন্নীত হয়।
তথ্যসূত্র : ইসলাম অনলাইন ডটনেট ও টিআরটি ওয়ার্ল্ড
কিউটিভি/আয়শা/২০ মার্চ ২০২৪,/দুপুর ২:৩৩