
ডেস্কনিউজঃ বিএনপির ঘোষণা অনুযায়ী আজ মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে। জামায়াতে ইসলামীও একই সময়ে অবরোধ পালনের ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির সমমনা দলগুলোও অবরোধে সমর্থন দিয়ে মাঠে থাকার কথা জানিয়েছে।
গতকাল সোমবার বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘সর্বাত্মকভাবে’ অবরোধ কর্মসূচি পালনের জন্য দেশবাসী ও দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রেলপথ, রাজপথ, মহাসড়ক, সড়ক ও নৌপথে এই অবরোধ চলবে। সংবাদপত্রের গাড়ি, অ্যাম্বুল্যান্স এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার পরিবহনের গাড়ি অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে।
বিএনপি ছাড়াও গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, গণফোরাম-পিপলস পার্টি, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণ অধিকার পরিষদ, লেবার পার্টি, এনডিএমসহ সরকার পদত্যাগের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত দলগুলো আলাদাভাবে অবরোধ কর্মসূচি পালন করবে।
যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকা জামায়াতে ইসলামীও গতকাল দুপুরে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গতকাল এক সংবাদ বিবৃতিতে দলের ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমান এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এই কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় বিএনপি ও সমমনারা। বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা দলগুলো রাজপথের কর্মসূচিতে সহিংসতা বাড়ালে তা মোকাবেলায় বল প্রয়োগও বাড়াবে সরকার।
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে যতটা সম্ভব কঠোর ভূমিকায় থাকবে আওয়ামী লীগ ও সরকার। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকেও সরকার থেকে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে এমনটা জানিয়েছেন।
দলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র জানায়, গত ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় বিএনপির কর্মসূচি সহিংস হয়ে ওঠায় বিশেষ সতর্ক হয়ে উঠেছে সরকার এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়। তাঁরা মনে করছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপি আরো বেশি সহিংসতার চেষ্টা চালাবে।
আর তা মোকাবেলায় আরো বেশি বল প্রয়োগ ছাড়া বিকল্প নেই। আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ বিএনপি সে পথে হাঁটছে না।
গত রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, সংলাপের পথ বিএনপি রুদ্ধ করে দিয়েছে। এখন আর সে সুযোগ নেই। তিনি বিএনপিকে বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচনকালীন সরকার গঠনেরও ইঙ্গিত দেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইলেকশন টাইমে যদি বাইরের কাউকে যুক্ত করাও হয়, তাহলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের করব। তাদের তো কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। পদত্যাগ করেছেন।’
রাজনৈতিক সমঝোতার পথ সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের লড়াইয়ে জোর দিচ্ছে আওয়ামী লীগও। তারা আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের মাঠে রাখতে নেতাদের জোরালো তাগিদ দিচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার রাজপথ যেন বিএনপি-জামায়াত ও সমমনা দলগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারে সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তবে আজ থেকে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচির বিপরীতে পাল্টা নতুন কোনো কর্মসূচি দেবে না আওয়ামী লীগ। তারা পূর্বঘোষিত শান্তি সমাবেশ কর্মসূচিই পালন করতে থাকবে।
ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি রাজনৈতিক সমঝোতার পথ সিলগালা করে দিয়েছে। তারা ঢাকায় এসে যে সন্ত্রাস করেছে তা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাইছে। আমরাও সারা দেশের জেলা-উপজেলায় নেতাকর্মীদের সতর্ক পাহারায় থাকার নির্দেশনা দিয়েছি।’
ঢাকা মহানগরে সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, মহানগরে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের রাজপথ দখলে রাখার বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। থানা ও ওয়ার্ডভিত্তিক দায়িত্ব ভাগ করে সুনির্দিষ্ট কাজ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপির অবরোধ চলাকালে প্রতিটি ওয়ার্ডের দু-তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আমাদের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেবে। কোনো নাশকতার চেষ্টা দেখলে তারা তা প্রতিহত করবে।’
গতকাল সোমবার সকালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের দলীয় সংসদ সদস্য এবং সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন। সভা থেকে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত ঢাকার রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে সর্বোচ্চ কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে জানানো হয়েছে, ঢাকার রাজপথ দখলে ব্যর্থ হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নাশকতা চালাতে পারে বিএনপি-জামায়াত। সেই চেষ্টা যেন সফল না হয় তা যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে হবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে রাজপথ দখলের যে চেষ্টা ছিল, তা ব্যর্থ হয়ে গেছে। এতে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা তৈরি হয়েছে। ফলে আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপি যেসব কর্মসূচি দেবে তা মোকাবেলা করা আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি কথা রাখেনি। তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে সন্ত্রাস করেছে। তারা আবারও ২০১৩-১৪ সালের মতো সন্ত্রাসের পথ নিয়েছে। আশা করি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এগুলো সফল হতে দেবে না। পাশাপাশি আমাদের কর্মীরাও সতর্ক অবস্থানে থাকবে। যেকোনো মূল্যে শান্তি রাখার জন্য আমরা কাজ করব।’
এদিকে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং দলের মহাসচিবকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় আপাতত হরতাল-অবরোধের বিকল্প ভাবছে না বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, ধারাবাহিক অবরোধ সফল করতে পারলে সারা দেশ থেকে রাজধানী ঢাকা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাতে সরকারের ওপর সব মহলের চাপ আরো বাড়বে। এর মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা ঠেকানোও লক্ষ্য দলটির।
বিএনপির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, বৃহস্পতিবার প্রথম দফা অবরোধ কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর আগামী রবিবার থেকে আবার একই রকম কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। দলের স্থায়ী কমিটির গত দুই বৈঠকে সার্বিক রাজনৈতিক বিষয় পর্যালোচনা করে এমন সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার, দলের অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করতে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি, সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৫২ মামলা এবং তাতে কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা—পুরো ঘটনা যে সরকারের পরিকল্পনার অংশ, তা এখন স্পষ্ট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, বিএনপির হারানোর কিছু নেই। ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় বিএনপির কোনো ক্ষতি হয়নি। বরং আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, তা ধরে রাখতে পারলে বিএনপিই লাভবান হবে। ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে চাপে ফেলাই এখন লক্ষ্য। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নয়াপল্টনের শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ নিয়ে সরকার যা করেছে, তা পূর্বপরিকল্পিত।
বিশেষ উদ্দেশ্যে সভার অনুমতি দিয়ে সরকার বিরোধী দলের ন্যায়সংগত দাবিকে নস্যাৎ করতে পুলিশের ওপর হামলার অজুহাতকে ব্যবহার করে ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু করেছে। এর ফলে এক দিনেই বাংলাদেশের পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে।’
অবরোধ নিয়ে বিএনপির পরিকল্পনা
দলের দুজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবরোধের মাধ্যমে ঢাকাকে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় বিএনপি। সারা দেশের সব ইউনিটকে মাঠে থেকে রাজপথ ও রেলপথ অবরোধে কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্ব নিয়েছেন।
ঢাকা মহানগর বিএনপির একটি সূত্র জানায়, নগরীর উত্তর ও দক্ষিণকে ১৬টি ভাগে ভাগ করে নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মহানগর নেতাদের সঙ্গে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা সমন্বয় করে কাজ করবেন।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো কঠোর কর্মসূচিতে না গিয়ে একেবারে গণতান্ত্রিক নিরীহ কর্মসূচিতে ছিলেন তাঁরা। কিন্তু ২৮ অক্টোবর রাজনৈতিক সহিংসতা সৃষ্টি করে সরকার ও পুলিশ বিএনপিকে কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করেছে। এখন আর পেছনে ফিরবেন না তাঁরা। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা দলের আন্দোলন সমন্বয় করছেন। তাঁদের কৌশলগত অবস্থানে থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে অনুরোধ করেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। এ জন্য আপাতত জ্যেষ্ঠ নেতারা কেউ প্রকাশ্যে আসবেন না।
বিদেশি মিশনে চিঠি দিয়েছে বিএনপি
২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনার জন্য সরকার ও পুলিশকে দায়ী করে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দূতাবাসকে ব্রিফিং করার আগেই বিএনপি দূতাবাসগুলোতে চিঠি পাঠায়।
বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন কালের কণ্ঠকে বলেন, কিভাবে সরকার সহিংসতা সৃষ্টি করেছে তার প্রমাণাদিসহ দূতাবাসগুলোতে পাঠানো হয়েছে। কোন পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপিকে কঠোর কর্মসূচিতে যেতে হয়েছে, চিঠিতে তা উল্লেখ করা হয়েছে।
নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয় অবরুদ্ধ
‘ডোন্ট ক্রস ক্রাইম সিন’ লেখা হলুদ টেপ দিয়ে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় গতকালও তিন দিক ঘিরে রাখা হয়েছিল। দুই প্রান্তে এক স্তরের পুলিশ অস্ত্র হাতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। কার্যালয়ের প্রধান গেটও ছিল বন্ধ।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, বিএনপির অফিস এখন সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের নিয়ন্ত্রণে। এখানে তাঁরা তদন্ত করছেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে লাইটপোস্টগুলোতে নতুন করে আরো সিসিটিভি লাগানো হচ্ছে। তবে কার্যালয়ের সামনের সড়কে স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল করছে। কার্যালয় বন্ধ হয়ে পড়ায় গতকাল নেতাকর্মীদের এই এলাকায় দেখা যায়নি।
বিপুল/৩১.১০.২০২৩/ সকাল ১১.২৭