রুমকী’র চিঠি -১ : মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি

superadmin | আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২৩ - ০১:৫৫:০০ পিএম

 মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি
——————————————————–
রুমকী অনেকটাই বদলে গেছে। আগের মত আবেগীয় কথা, কাজ, চিন্তাধারা অতঃপর এই ভাবনার অতলান্ত সাগরে এখন আর ডুব দেয়না। ২৫ বছর পর ২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরের দিন আচমকা নাহিদের জীবনে কড়া নারে রুমকী। বৃষ্টি ভেজা ঈদের দিনে নাহিদকে নিয়ে প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নস্টালজিয়ার সেই আগুনঝরা দিনগুলোতে ফিরে যায় দুজনে।

পুরো ৪৮ ঘন্টার এই অভিযাত্রায় নাহিদের মুখ থেকে রুমকী টেনে বের করে এনেছিল ৮০ দশকের স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের চুলচেরা ইতিহাস। ঈদের দিন রাতে নাহিদ, কমল, মুহিদ, নিপা মিলে ওরা ৫ জন হারিয়ে গিয়েছিল ৩৩ বছর আগের সেই সোনাঝরা দিনগুলোতে। এই আলাপচারিতায়, এই আড্ডায় আর কিছু না হোক ”নাহিদ-রুমকীর ক্যাম্পাস উপাখ্যান” সৃষ্টি করেছিল এক তুষের আগুনে ধিকিধিকি জ্বলা দ্রোহে পোড়া নির্মম এক ইতিহাস।

৪৮ ঘন্টার নাটকীয় এই অতীত কথন শেষে রুমকী নাহিদকে অবাক করে দিয়ে এয়ারপোর্ট নিয়ে যায়। বিদায় জানায় বাংলাদেশকে, বিদায় জানায় নাহিদকে। আবার সে ফিরে যেতে চায় তার আপন ডেরা নিউইয়র্কের কুইন্সের কিউ গার্ডেনে। ঢাকা এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন ত্যাগ করার পূর্বে রুমকী কথা দিয়েছিল নাহিদকে। তারা নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করবে। কথা বলবে লং ডিসট্যান্স কল হোয়াটস্যাপ অথবা মেসেঞ্জারে। সেই কথা আগামী বই মেলায় যেন আরেকটি নাহিদ-রুমকীর অধ্যায় সৃষ্টি করে। শিরোনাম রুমকী ঠিক করে দিয়েছিল, নাহিদ-রুমকীর অসমাপ্ত কথোপকথন।

রুমকীকে বিদায় জানিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে নাহিদ। তাকিয়ে আছে সে রানওয়ের দিকে। ঠিক ১.৪৭ মিনিটে রানওয়েতে ছুটছে থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইট TG-৩২২ এর এয়ার বাস A350-900। প্রকট গর্জন তুলে আকাশে ডানা মেলল। একমনে তাকিয়ে আছে নাহিদ উড়ন্ত এয়ারক্রাফটের দিকে। ঈদের দিনের রাতে নিপা আর রুমকীর গাওয়া দ্বৈতকণ্ঠের গানের কথাগুলো মনে পড়ল নাহিদের। গানের শেষের কথা গুলো কানে বাজছে শুধু। অসীম আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নাহিদ মনে মনে ভাবছে খাঁচায় বন্দি হয়ে তার পাখি উড়ে যাচ্ছে।

যদি কোনোদিন আমার পাখি
আমায় ফেলে উড়ে চলে যায়
এক একা রবো নিরালায়

পাখি রে, তুই কবে আমার আপন হবি
কিছুই জানি না

পাখি রে, তুই দূরে থাকলে
কিছুই আমার ভালো লাগে না
পাখি রে, তুই…

নাহিদ পা ফেলল পার্কিং এর দিকে। কিন্তু তার দু’চোখ বেয়ে অঝর ধারায় টপ টপ ঝরছে নোনা কিছু জল।

২০১৯ সালের ঈদুল ফিতর আর আজ ২০২৩ সালের ২২ শে জুলাই। এরমাঝে চার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বলতে গেলে এই চার বছরে নাহিদ-রুমকী নিয়মিত কথা বলেছে। দেশ জাতি, সমকালীন রাজনীতি, সাহিত্য সংগীত সব বিষয় নিয়েই কথা বলেছে দুজনে। ব্যস্তময় অস্থির পৃথিবী শান্ত করে দিতে করোনা এসেছিল। থেমে গিয়েছিল পৃথিবী। কিন্তু থামেনি নাহিদ-রুমকীর অসমাপ্ত কথোপকথন।

ইদানিং এক নতুন খেলায় মেতে উঠেছে রুমকী। ইদানিং সে লং ডিসট্যান্স কলে কথা বলে কম। লিখে বেশি। নাহিদকে নিয়মিত চিঠি লিখে রুমকী। এই চিঠি পোস্টমাস্টারের সিলমারা খামের চিঠি নয়, এই চিঠি ডাক হড়করার কাঁধে ঝোলা ব্যাগের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা চিঠি নয়। এই চিঠি লিখে সে হোয়াটস্যাপ এ। নিউইয়র্কের কুইন্সে কিউ গার্ডেন এর সুউচ্চ টাওয়ারের এপার্টমেন্টে আকাশ ছুঁয়ে চিঠি লিখে সে। নাহিদ সে চিঠি পড়ে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। মতিঝিলে অফিস পাড়ার ক্লান্ত বিকেলে চিঠি পড়ে আর নাহিদ চোখ মুছে।

রুমকী আজ লিখেছে নাহিদকে। ”মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি, আমার পরানে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি”। মীরাদেব বর্মন এর লেখা আর শচীনদেব বর্মন এর সুরারোপ ও উননাসিক কণ্ঠের এই গানের কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছে রুমকী। রক্তফোঁটার মত রুমকী’র গোটাগোটা লেখাগুলো পুরো মনোযোগ দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। রুমকী লিখেছে,এইতো কিছুদিন আগে মীরাদেব বর্মনকে নিয়ে কি এক নান্দনিক লেখা লিখেছিলে তুমি। তোমার লেখা পড়ে কুমিল্লায় ঝড় উঠল,সারা বাংলাদেশে হুলস্থূল কান্ড বাধিয়ে ফেললে। পশ্চিমবঙ্গ সহ পুরো ভারতবর্ষের বাংলা ভাষাভাষীরা গ্রোগ্রাসে গিলল তোমার দেয়া নতুন এক নাম গোমতী কন্যা মীরাদেব বর্মন।

রুমকীর লেখাগুলো সব পড়া হয়নি। এরমাঝেই রুমকী হোয়াটস্যাপ এ কল দিয়ে আসল। নাহিদের সেকি উচ্ছাস ! রুমকী তোমার চিঠি পড়ছিলাম। কি আশ্চর্য ,ঠিক এসময়েই তোমার কল? রুমকী হাসতে হাসতে বলল, আমি কথা বলার জন্যে কল দেইনি। এখন আমি মীরাদেব বর্মনের কথা গুলো কিন্নর কণ্ঠে গাইব। তুমি রেডিতো ? শুনবে আমার সেই গান ? নাহিদ সায়াহ্ন পূর্ব গোধূলি বেলায় তার অফিস কক্ষটিতে সিটকিনি লাগিয়ে রুমকীর কিন্নর কণ্ঠে গাওয়া গান শুনতে লাগলো-

বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে এ কী তব হোরি খেলা
তুমি যে ফাগুন রঙের আগুন তুমি যে রসের ধারা
তোমার মাধুরী তোমার মদিরা করে মোরে দিশাহারা
মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরানে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি।।

প্রেমের অনলে জ্বালি যে প্রদীপ সে দীপের শিখা তুমি
জোনাকি পাখায় ঝিকিমিকি নেচে এ হৃদি নাচালে তুমি
আপন হারা এ উদাসী প্রাণের লহ গো প্রেমাঞ্জলি
তোমারে রচিয়া ভরেছি আমার বাউল গানের ঝুলি
মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরানে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি।

চমকি দেখিনু আমার প্রেমের জোয়ার তোমারই মাঝে
হৃদয় দোলায় দোলাও আমারে তোমার হিয়ারই মাঝে
তোমার প্রাণের পুলক প্রবাহ মিশিতে চাহে আমাতে
জপ মোর নাম গাহ মোর গান আমারই একতারাতে
মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরানে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি।

(চলবে)

 

লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।

 

 

নাহিদা/২৪.০৭.২০২৩/দুপুর ১.৪৫

▎সর্বশেষ

ad