বিশেষ প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি’র অধিকাংশ জেলা ও মহানগর কমিটি গুলোর আহবায়ক কমিটি ইতোমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। কমিটিগুলোর ধরণ ছিল সর্বশেষ কমিটির সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদককে পুনঃ পদায়ন না করা। এমনকি আহবায়ক, যুগ্ম-আহবায়ক অথবা সদস্য সচিব পদে একেবারেই নুতন মুখের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কেবলমাত্র রংপুর জেলায় নেতৃত্ব সংকটের কারণে সভাপতি সাইফুল ইসলামের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে তাঁকে আহবায়কের পদ দেয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম সহ বেশ কয়েকটি জেলা কমিটি এখন পর্যন্ত ঘোষিত হয়নি। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির মেয়াদ প্রায় ৮ বছর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে। দীর্ঘ বিলম্বই শুধু কারণ নয়, অভ্যন্তরীণ নানান কোন্দল,দ্বন্দ ও গ্ৰুপিং এর কারণে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির এখন বেহাল দশা। দলের মধ্যে চেইন অব কমান্ড নেই, অসংগঠনিক কর্মতৎপরতার মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির নেতৃত্ব সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি সহ জেলার সকল ইউনিটের নেতাকর্মী গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। যদিয় কেন্দ্রে কুড়িগ্রাম জেলার সন্তান এডঃ রুহুল কবির রিজভী কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব পদে এবং আব্দুল খালেক রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। কিন্তু কুড়িগ্রামের স্থানীয় মানুষ হয়েও জেলা বিএনপির এই বহাল অবস্থা থেকে পরিত্রানের বিষয়ে যৌক্তিক কোন পদক্ষেপ তাদের পক্ষ থেকে লক্ষ্য করা যায়নি বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা অনুযোগ করেছেন।
এছাড়াও রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুর বিরুদ্ধে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির বিবাদমান দুটি গ্ৰুপের মধ্যে সভাপতি তাসভির উল ইসলামের গ্ৰুপের প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতা ও পক্ষপাত মূলক ভূমিকা রাখার অভিযোগ সর্বজনবিদিত। কিন্তু সি: যুগ্ম-মহাসচিব এডঃ রুহুল কবির রিজভী কুড়িগ্রাম জেলার দুই পার্টি অফিস ভিত্তিক গ্ৰুপিং রাজনীতির প্রধান নেতৃত্বদানকারী সভাপতি তাসভির উল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানার প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোন সমর্থন ও ভূমিকা কখনই প্রদর্শন করেননি। সাম্প্রতিক কালে রংপুর বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক আব্দুল খালেক তার নিজ বলয় সৃষ্টিকল্পে দু তিনটি অঙ্গদলের কমিটি প্রদানে সরাসরি ভূমিকা রাখতে যেয়ে জেলার রাজনীতিতে আরও সমস্যা সৃষ্টি করেছেন বলে অনেকেই মনে করেন।
গঠনতন্ত্র উপেক্ষা, স্বেচ্ছাচারিতা, গ্রুপিং, ব্যক্তিগত স্বার্থে কমিটি গঠন, সর্বোপরি কেন্দ্রীয় বিএনপি’র তদারকি না থাকায় কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি এখন বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। ফলে দুই গ্রুপের যাঁতাকলে পড়ে নেতাকর্মীরা ছটফট করছে। তারা না পারছে সৈতে, না পারছে কিছু কইতে কিন্তু পার্টির যা ক্ষতি হওয়ার তা প্রতি মুহূর্তে হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর জেলা বিএনপি সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হয়। তাতে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি তাসভীর উল ইসলাম সভাপতি ও সাইফুর রহমান রানা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৫১ বিশিষ্ট কমিটি ২ বছরের জন্য গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের পর কিছুদিন যেতে না যেতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় দলের মধ্যে বিভক্তি। পরবর্তীতে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও রূপ নেয়। কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির দ্বন্দ্বের সূচনা সৃষ্টির পিছনে সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানার বোন জামাই যুগ্ম-সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদের ভূমিকা দিয়েই শুরু হয়েছে বলে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপি ও অঙ্গদলের অনেক নেতাকর্মী স্বীকার করেছেন। উল্লেখ্য সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদ তার নিকট আত্মীয় সাইফুর রহমান রানার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সভাপতি তাসভির উল ইসলাম এর পক্ষাবলম্বন করেছেন।
কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা দুই দশক এবং সভাপতি পদে তাসভির উল ইসলাম প্রায় দেড় দশক যাবৎ তাদের স্ব স্ব পদে থেকে রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। কুড়িগ্রাম বিএনপিতে এই তিনজন ব্যক্তির কারণে সৃষ্ট জটিলতা নতুন কমিটি ঘোষণা ব্যাতিত যে সহসাই নিরসনের কোন উপায় নেই তা তৃণমূলের সকলই অকপটে স্বীকার করেছেন।
গত ২০২০সালের ১৯ আগস্ট কুড়িগ্রাম শহরের ভেলাকোপা এলাকায় বিএনপির পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সামনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমানসহ ১০ জন মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনায় কেন্দ্র থেকে সাইফুর রহমান গ্রুপের সাইফুর রহমানকে ও তাসভীর গ্রুপের যুগ্ম সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদকে শোকজ করা হয়। সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা ও যুগ্ম সম্পাদক সোহেল হোসনাইন কায়কোবাদকে এক মাসের জন্য দলের সকল কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন কেন্দ্রীয় বিএনপি। তাতেও গ্রুপিং মীমাংসিত হয়নি।
পরবর্তীতে গ্রুপিং আরো তীব্র আকার ধারণ করে দুটি পার্টি অফিসের জন্ম হয়। দলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা শহরের পোস্ট অফিস পাড়া থেকে এবং সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম আমিন মোক্তার পাড়াস্থ অফিস থেকে দায়সারা ভাবে বিএনপি কার্যক্রম চালাচ্ছেন। দুই গ্রুপের গ্রুপিং ছড়িয়ে পড়েছে ওয়ার্ড পর্যায়েও। কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সকল উপজেলা ও পৌর শাখাসহ অঙ্গদল সমূহে দ্বন্দ্বের প্রভাব পড়েছে। জেলা বিএনপির গ্রুপিং নিরসনের জন্য দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে গত ২০২১ সালের ১ফেব্রুয়ারী দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি ২০২১ সালের ১২ মার্চ দুই গ্রুপের ৭জন করে মোট ১৪ নেতার সাথে ঢাকায় বৈঠক করে কেন্দ্রে রিপোর্ট জমা দেন। ঐ বৈঠকের সদস্য জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি শফিকুল ইসলাম বেবু বলেন, ঐ রিপোর্ট এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে, গত ১৬ জুন’২০২৩ কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানা সদর উপজেলা বিএনপির কমিটি অনুমোদিত হওয়া সত্ত্বেও একক সিদ্ধান্তে জহুরুল আলমকে আহবায়ক ও মাজেদুল ইসলাম তারাকে সদস্য সচিব করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট আরও একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করেন। পরে সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম সমর্থিত জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও দপ্তরের দায়িত্বে নিয়োজিত আশরাফুল হক রুবেল প্রেস রিলিজ দিয়ে ঘোষিত কমিটির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক একক ভাবে কোন কমিটি দলের সংবিধান মোতাবেক অনুমোদনের এখতিয়ার রাখেন না। সদর উপজেলা বিএনপির কমিটিসহ ইতোপূর্বে তিনি যে সকল কমিটি একক স্বাক্ষরে অনুমোদন করেছেন তা যেমন অবৈধ তেমনি অসাংগঠনিক।
এ বিষয়ে সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম বলেন, জেলা বিএনপির ৯০ ভাগ নেতা কর্মী আমাদের সাথে রয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য কিছু লোক বিরোধীতা করতেই পারে। সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া কেন্দ্রকে অবহিত করা হয়েছে। সম্প্রতি সাধারণ সম্পাদক একক সিদ্ধান্তে সদর উপজেলা বিএনপির কমিটি দেয়া গঠনতন্ত্র পরিপন্থী বলে জানান তিনি। সাধারণ সম্পাদক এহেন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দলের মহাসচিব বরাবর চিঠি লেখার কথাও জানান জেলা বিএনপির সভাপতি তাসভীর উল ইসলাম ।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান রানার সঙ্গে স্থানীয় সংবাদ প্রতিনিধিগণ যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘সভাপতি তাসভীর সাহেব কুড়িগ্রামের রাজনীতির মাঠে আন্দোলন সংগ্রামে উপস্থিত থাকেননা, আন্দোলন বেগবান করতেই সদর উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি করে দিয়েছি। দীর্ঘ প্রায় কুড়ি বছরের পূরানো অফিসে না এসে সভাপতি তাসভীর কি কারণে শহরের অদুরে আলাদা অফিস খুলেছেন তা বোধগম্য নয় বলে মন্তব্য করেন সাধারণ সম্পাদক।
কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, গঠনতন্ত্র মোতাবেক দুই বছরের মেয়াদের কমিটি প্রায় ৮ বছর ধরে চলছে। দুই বছর পর পর কমিটি গঠিত হলে দলের মধ্যে এই বিভাজন থাকত না। তিনি আরো বলেন জেলা কমিটির ১৫১ সদস্যের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ২০ থেকে ২৫জন সক্রিয় থাকলেও গ্রুপিং এর কারণে কমিটির বড় অংশ নিষ্ক্রিয়। এই নিষ্ক্রিয় কমিটির নেতৃবৃন্দই মূলতঃ কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির নিবেদিত প্রাণ। এদের সংখ্যাটাই সব থেকে বেশি। তৃণমূলের অভিমত দ্রুত কমিটি গঠন করলে গ্রুপিং নিরসন সম্ভব হবে।
কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির আরেক সহ-সভাপতি অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বেবু বলেছেন, কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণার বিষয়টি অতীব জরুরি। আমি বর্তমান কমিটির অনেক অবৈধ, অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপ বিষয়ে সম্প্রতি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি। আশা করছি তিনি সহসাই সব কিছুর সমাধান করে দিবেন।
৮০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা, কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি, ২০০১ সালে ক্ষমতাসীন বিএনপি ও চারদলের কুড়িগ্রাম- ২, সদর আসনের প্রাথী লুৎফর রহমান এর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ২০১৫ সালে কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সম্মেলন ও কাউন্সিল যে দিন অনুষ্ঠিত হয় সেদিন থেকেই মূলতঃ দলীয় অনিয়ম ও অসাংগঠনিকতা শুরু হয়। কুড়িগ্রামের কৃতি সন্তান রুহুল কবির রিজভী তখন কারারুদ্ধ। অনুষ্ঠিত কাউন্সিল ও সম্মেলনটি ছিল একটি সাজানো প্যাকেজ। নিজেদের নেতৃত্ব বহাল রাখার এই হীন স্বার্থ কায়েমের প্রক্রিয়া আমি সেদিন বর্জন করেছিলাম। একটি অন্যায়, অনিয়ম, অসাংগঠনিক ও অনৈতিকতার পরিণতি আজ কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির বেহাল অবস্থায় উপনীত করেছে।
লুৎফর রহমান আরও বলেন, আমি সেদিন সম্মেলন বর্জন করেছি, কোন পদ গ্রহণ করিনি। যারা পদ রিনিউ করেছেন তারা আজ নিজে যেমন বিতর্কিত তেমনি কুড়িগ্রাম বিএনপির সর্বনাশ করেছেন। প্রাথমিক সদস্য পদ ছাড়া আমার কোন পদ নেই গত ৮ বছর যাবৎ, আমি পদের রাজনীতি করিনা। তবে, আই শ্যাল ফাইট ফর কুড়িগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট বিএনপি টিল দ্য ইন্ড, আই শ্যাল নেভার সাইলেন্স, আই শ্যাল নেভার স্যারেন্ডার।
১৯.০৬.২০২৩। রাত ১১.৩৯