তিনি ছিলেন আব্বাসীয় প্রথম খলিফা আবুল আব্বাস আস-সাফফাহর বড় ভাই। আবুল আব্বাস আস-সাফফাহ ৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তখন আবু জাফর পবিত্র হজ উপলক্ষে মক্কায় ছিলেন। এ কারণে আবুল আব্বাস আস-সাফফাহর মৃত্যুর পর তাঁর ভাতিজা ঈসা তাঁর অনুপস্থিতিতে আবু জাফরের নামে শপথ বাক্য পাঠ করেন। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে আবু জাফর হজ শেষে দ্রুত কুফায় ফিরে আসেন। এ সময় তিনি মসজিদ প্রান্তরে প্রথম উদ্বোধনী ভাষণ প্রদান করেন।

ডেস্ক নিউজ : জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে যেসব মুসলিম খলিফা অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব খলিফা আল-মনসুর। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল মূলত আবু জাফর। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করার পর নিজেকে আল-মনসুর (বিজয়ী) বলে ঘোষণা করেন। তখন থেকে তিনি আল-মনসুর নামে বেশি পরিচিত।
মনসুরের ব্যক্তিগত জীবন ছিল সুন্দর, নির্মল ও পবিত্র। তিনি ছিলেন একদিকে ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক, পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, দূরদর্শী এবং জনদরদি। তিনি তাঁর বন্ধুদের প্রতি ছিলেন খুবই কোমল আর শত্রুদের প্রতি ছিলেন কঠোর ও নির্মম। ন্যায়নিষ্ঠা, মিতব্যয়িতা, কর্মতৎপরতা ও প্রজাসাধারণের প্রতি দরদি মন তাঁকে সদা কর্মচঞ্চল করে রাখত।
তিনি ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও শাসক। তাঁর ন্যায়বিচার ও ন্যায়দর্শিতা ছিল প্রশংসনীয়। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিচার তাঁর নিজের বিপক্ষে গেলেও তিনি তা মাথা পেতে নিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। একবার কয়েকজন উটের মালিকের অভিযোগে মদিনার বিচারক খলিফা মনসুরকে তাঁর বিচারালয়ে হাজির হতে বলেন। মনসুর বিনা দ্বিধায় বিচারালয়ে উপস্থিত হয়ে সাধারণ আসামিদের মতো বিচারকের সামনে দাঁড়ান। বিচারে মনসুর দোষী সাব্যস্ত হন। মনসুর বিচারকের সৎসাহসের জন্য ধন্যবাদ জানান ও তাঁকে প্রচুর অর্থ দ্বারা পুরস্কৃত করেন।
তাঁর সময় আব্বাসীয় খিলাফত সামরিক শক্তিতেও উন্নতি সাধন করেছিল। তাঁর আমলে রোমান সম্রাট চতুর্থ কনস্টানটাইনকে ৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত করে মালাসীয় দুর্গ পুনরুদ্ধার করা হয়। শুধু তা-ই নয়, তিনি গ্রিক সীমান্তেও নতুন দুর্গ নির্মাণ করেন। এ ছাড়া তাবারিস্তান, আর্মেনিয়া, কুর্দিস্তান ও উত্তর আফ্রিকা জয় করে তাঁর শাসনাধীনে নিয়ে আসেন।
তাঁর শাসনামলে জনসাধারণের কল্যাণের জন্য তিনি বহু নগর, সরাইখানা, চিকিৎসালয়, রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণ করেন। এমনকি তাঁর আমলেই মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের উন্মেষ ঘটে। মধ্যযুগের বিশ্বসভ্যতার চারণভূমি সৌন্দর্যের নগরী বাগদাদ প্রতিষ্ঠা তাঁর অমর কীর্তি। তা ছাড়া কুফা ও বসরা নগরীর প্রাচীর, রুসাফা নামক রাজপ্রাসাদ তাঁর উন্নত শিল্প মনের পরিচয় বহন করে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর ভীষণ ঝোঁক ছিল। তাই তিনি এই শাখার উন্নতিতে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন। তাঁর সময় থেকে মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে সোনালি যুগের সূচনা হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল সম্পদ সংগ্রহ করে মুসলমানগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে চরম উৎকর্ষ লাভ করে এর তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তাঁর সময়ে সাহিত্য, ইতিহাস, গণিত, চিকিৎসা, দর্শন ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের গভীরচর্চা শুরু হয়। তাঁর আদেশে গ্রিক ও ভারতীয় পণ্ডিতদের দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাবলি অনূদিত হয়। মনসুরের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলমান পণ্ডিতগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ ঘটান।
বিশ্ব সভ্যতায় মুসলিম অবদান গ্রন্থের লেখক নূরুল হোসেন খন্দকার তাঁর ব্যাপারে লেখেন, আল-মনসুর কেবল জ্ঞানী ও বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, তিনি নিজেও একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা তাঁর খুব প্রিয় ছিল। রাজকীয় কাজ থেকে একটু অবসর পেলেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান সাধনায় ডুবে যেতেন। তাঁকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ তিনি আরবের প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী। সুপ্রসিদ্ধ ইউরোপীয় ঐতিহাসিক মি. বোসো বলেন, ‘আর জ্যোতির্বিদদের মধ্যে খলিফা আল-মনসুর সর্বপ্রথম।’
তথ্যঋণ : ইসলামের ইতিহাস প্রথম পত্র, বিশ্ব সভ্যতায় মুসলিম অবদান
কিউটিভি/আয়শা/২৭ এপ্রিল ২০২৩,/রাত ৮:০৫