ওষুধের আগ্রাসী বিপণনে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন

Anima Rakhi | আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ১০:২৫:০৩ এএম

ডেস্ক নিউজ : ওষুধ কম্পানিগুলোর লাগামহীন মার্কেটিং খরচ আর ডিস্ট্রিবিউশন চেইনে অতিরিক্ত কমিশনে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার। ভোক্তার অধিকার রক্ষায় সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কঠোর তদারকি এবং ওষুধের দাম নির্ধারণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। 

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ড্রাগ অ্যাক্টের পরও ওষুধ বাজারে মার্কেটিংয়ের নামে অনৈতিক চর্চায় ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে এবং অবিলম্বে তা বন্ধ করা জরুরি। 

প্রশ্ন : সম্প্রতি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জানিয়েছেন, একটি ওষুধ কোম্পানি বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা কমিশনে ব্যয় করে। আপনার মতে, এই অস্বাভাবিক কমিশন বাণিজ্য ও অনৈতিক চর্চায় টিকতে না পেরে কি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বাজার থেকে সরে গেছে?

উত্তর : কোন কোম্পানি কতটা কমিশন ব্যয় করে, তা আমার জানা নেই। তবে এটি সত্য, দেশের নিজস্ব ওষুধনীতির কারণে গত ৩০ বছরে দেশীয় কোম্পানিগুলো বিশ্বমানের হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশের ৯৭ শতাংশ ওষুধ দেশীয় কোম্পানিগুলোই উৎপাদন করে এবং প্রায় ১৫০টি দেশে তা রপ্তানি করা হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস চুক্তির আওতায় আমরা একটি স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ হিসেবে সম্পূর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়েছি, যা আমাদের ওষুধশিল্পকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে কি না তা আমার জানা নেই, তবে এটা সত্যি, দেশীয় কোম্পানিগুলো তাদের তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে ফেলেছে। ওষুধ রপ্তানি এখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। তবে কমিশন বাণিজ্যের নেতিবাচক দিক অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ওষুধশিল্পের সাফল্য ধরে রাখতে অসচ্ছতা ও অনিয়মের পথ বন্ধ করতে হবে। ভোক্তার স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আগ্রাসী বিপণন বন্ধ করতে হবে।

প্রশ্ন : দেশে ওষুধের দাম বৃদ্ধির পেছনে কোন কোন বিষয় দায়ী?

উত্তর : ওষুধের দাম বেশি কি না তা সঠিকভাবে জানতে হলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দামের সঙ্গে তুলনা করে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারি সংস্থা হিসেবে ডিজি ড্রাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে তাদের ক্ষমতা সীমিত। ডিজি ড্রাগ কেবল এসেনসিয়াল ড্রাগগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে, যা ওষুধের মোট সংখ্যার তুলনায় খুবই কম। বাকি অধিকাংশ ওষুধের মূল্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো নিজেরাই নির্ধারণ করে। যেহেতু এর ওপর কোনো কার্যকর সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো মূল্য নির্ধারণ করার সুযোগ পায়। যদি কোনো ওষুধের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারে, তবে সেটার দৃষ্টান্ত খুবই কম। এই প্রক্রিয়ার দুর্বলতাই ওষুধের উচ্চমূল্যের জন্য মূল দায়ী বলে মনে করি।

প্রশ্ন : ডিস্ট্রিবিউশন চেইনের প্রতিটি ধাপে কমিশন ও অতিরিক্ত মার্জিন যোগ হওয়ার বিষয়টি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে?

উত্তর : ডিস্ট্রিবিউশন চেইনের প্রতিটি ধাপে কমিশন ও মার্জিনের পরিমাণ কতটা হওয়া উচিত, তা একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে এই প্রক্রিয়ায় কোনো স্বচ্ছতা নেই। অনেক সময় ‘পুশ সেল’-এর জন্য ডিস্ট্রিবিউটর, ফার্মেসি এবং খুচরা বিক্রেতাদের অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া হয়। এই অতিরিক্ত কমিশনগুলো শেষ পর্যন্ত যোগ হয় ওষুধের মূল দামের সঙ্গে এবং তার পুরো চাপ এসে পড়ে সাধারণ ভোক্তার ওপর। এই কমিশন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে একটি স্বচ্ছ মূল্য কাঠামো এবং কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন : ওষুধ কম্পানির বেপরোয়া মার্কেটিং খরচ শেষ পর্যন্ত রোগীর পকেট থেকে আদায় হচ্ছে- এটি কি ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘন নয়?

উত্তর : এটি কেবল ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘন নয়, এটি ড্রাগ অ্যাক্টের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ড্রাগ অ্যাক্ট অনুযায়ী ওষুধের অবাধ মার্কেটিং (ডাক্তারদের প্রমোশন, সেমিনার, গিফট, বিদেশ ভ্রমণ) করার সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মার্কেটিংয়ের নামে ওষুধ কম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা (মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ বা এমআরও) চিকিৎসকদের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ও অনার্থিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন মর্মে বিভিন্ন সংবাদ আমরা দেখতে পাই? এই অনৈতিক চর্চার কারণে কিছু চিকিৎসক অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন, যার ফলে রোগীর চিকিৎস খরচ বেড়ে যায়। এটি সরাসরি রোগীর পকেট থেকে আদায় করা হচ্ছে এবং এটি সুস্পষ্টভাবেই ভোক্তার অধিকার পরিপন্থী।

প্রশ্ন : ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বর্তমান পদক্ষেপগুলো কতটা কার্যকর বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : কার্যকারিতার দিক থেকে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পদক্ষেপে যথেষ্ট ঘাটতি এবং শিথিলতা রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো মাঝে মাঝে অভিযান পরিচালনা করলেও তা সমস্যার গভীরতা বিবেচনায় অপর্যাপ্ত। নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে কিছু কার্যক্রম দেখা গেলেও ওষুধের উচ্চমূল্য এবং অনৈতিক মার্কেটিংয়ের মতো গুরুতর বিষয়গুলো নিয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরো কঠোর ও নিয়মিত তদারকি ব্যবস্থ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন : জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে ওষুধ খাতের কী ধরনের অনিয়ম দেখছেন? ওষুধের দাম সাশ্রয়ী রাখতে ক্যাব কী ধরনের সংস্কার দাবি করছে?

উত্তর : ক্যাবের পক্ষ থেকে আমরা স্বাস্থ্য এবং ওষুধ খাত নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট টিম গঠন করে কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করেছি। আমাদের লক্ষ্য হলো, এই খাতে বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি-প্রস্তাব তৈরি করা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর আলোকে এই খাতে কাজের পরিধি সীমিত, তবে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ক্ষেত্রে কার্যক্রম গ্রহণের সুযোগ আছে। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এই সীমিত ক্ষমতা সত্ত্বেও অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যাপক কাজ করার সুযোগ আছে। সে লক্ষ্যেই ক্যাব তাদের কার্যক্রম গ্রহণ করবে এবং ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।

সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ।

অনিমা/১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, /সকাল ১০:২৪

▎সর্বশেষ

ad