
ডেস্ক নিউজ : রাজধানীতে বিভিন্ন ভবনে একের পর এক বিস্ফোরণে বাসিন্দাদের মধ্যে এবং নগরবাসীর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন সংস্থা দায় এড়িয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করলেও ভবনে জমে থাকা গ্যাসের কারণে বেশিরভাগ বিস্ফোরণ হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এসবের পেছনে গ্যাসের জরাজীর্ণ পাইনলাইন এবং পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্দশাই দায়ী। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের তদারকির অভাবে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তারা।
বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ইয়াসির আরাফাত খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিস্ফোরক কিংবা রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের পাশাপাশি বাতাসে গ্যাসের উপস্থিতিতে অনেক সময় ভবনে বিস্ফোরণ হতে পারে। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব, সিদ্দিকবাজার এবং ২০২১ সালে মগবাজার এলাকায় পৃথক ভবনের বিস্ফোরণের যে ঘটনা ঘটেছে তা প্রায় একই প্রকৃতির। এসব ভবনের বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে বাতাসের সঙ্গে মিশে এ ধরনের বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে। এর আগে মগবাজারে গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। সাধারণত বাতাসে প্রাকৃতিক গ্যাসের উপস্থিতি ৫ থেকে ৭ শতাংশ এবং এলপিজির উপস্থিতি ২ শতাংশের ওপরে গেলেই দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্যাসের লাইন এবং ওয়াসার স্যুয়ারেজ লাইনগুলো বেশ পুরনো। অনেক ক্ষেত্রে এসব লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে লিকেজের ঘটনা ঘটে। এমনকি গ্যাসের লাইন ছিদ্র হয়ে সেই গ্যাস স্যুয়ারেজ লাইন ও শৌচাগারের পাইপের মাধ্যমে ভবনে জমতে পারে। বদ্ধ স্থানে জমে থাকা এসব গ্যাস পরে বিস্ফোরণ কিংবা বৈদ্যুতিক স্পার্কের মাধ্যমে বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এসব লাইন নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের মাধ্যমে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।’
যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রকৌশলী ড. নাসির উদ্দীন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ভবনগুলোতে যেসব বিস্ফোরণ হয়েছে তার বেশিরভাগ মিথেন গ্যাসের কারণে হয়েছে। অনেক আগে থেকেই আমরা এটা বলে আসছি। কিন্তু আমলে নেওয়া হচ্ছে না।’তিনি বলেন, ‘অনেক ভবন অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণের কারণে সেখানে বাতাস বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। অন্যদিকে শহরের দুর্বল বর্জ্যব্যবস্থাপনা ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে এসব লাইন থেকে ভবনে মিথেন গ্যাস জমতে পারে সহজে। এ গ্যাস একসময় বিস্ফোরণ ঘটায় কিংবা অগ্নিকা- সূত্রপাত ঘটায়।’
‘কোনো বদ্ধ স্থানে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি ৫ শতাংশের বেশি হলেই সেখানে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এটি যদি ৯ শতাংশের ওপরে চলে যায় তাহলে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সম্প্রতি ঘটনাগুলো মিথেন গ্যাসের কারণে ঘটতে পারে বলে বিভিন্ন আলামতে বেশ স্পষ্ট হয়েছে। ভবন নির্মাণে যথাযথ নিয়ম মানার পাশাপাশি পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করার মাধ্যমে এসব দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। একই সঙ্গে ভবনের বাসিন্দাদেরও সতর্ক হতে হবে। সরকারিভাবে প্রয়োজনে বিভিন্ন এলাকায় যন্ত্রের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে মিথেন গ্যাসের মাত্রা পরিমাপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে’ বলেন ড. নাসির।
নানারকম জৈব পদার্থ পচে গিয়ে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, যা জলাভূমির গ্যাস নামেও পরিচিত। কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় মিথেনের ৮৪ গুণ বেশি ক্ষতি করার সক্ষমতা রয়েছে। গত মঙ্গলবার সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনার পর এর প্রকৃত কারণ এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানিয়েছে, ভবনের বেজমেন্টে গ্যাস বিস্ফোরণ হয়ে থাকতে পারে।
তাদের ধারণা, সেখানে দুটি ভবনের মাঝে থাকা একটি সেপটিক ট্যাংক থেকে গ্যাস নির্গত হয়ে থাকতে পারে। বিচ্ছিন্ন হওয়া কোনো গ্যাসের পাইপলাইন থেকে গ্যাস জমার পাশাপাশি দেয়ালে মিথেন গ্যাস জমতে পারে কোনোভাবে। পাশাপাশি পয়ঃনিষ্কাশন লাইনের পাইপ ছিদ্র হয়ে কিংবা ভবনে থাকা জেনারেটর থেকেও গ্যাস বের হয়ে জমতে পারে। ওই গ্যাস বেজমেন্ট কক্ষে জমে সেটি ‘গ্যাস চেম্বারে’ পরিণত হয়েছিল। সেখানে যেকোনো উপায়ে স্পার্ক (আগুনের স্ফুলিঙ্গ) হওয়ার পর ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। উদ্ধার হওয়া হতাহত ব্যক্তিদের শরীরে আঘাতের ধরন দেখেও ধারণা করা হচ্ছে, গ্যাস জমে এ বিস্ফোরণ হয়েছে।
তিতাসের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী সেলিম মিয়া জানান, দুর্ঘটনার পর অনুসন্ধানে বিস্ফোরণের শিকার ভবন দুটিতে তিতাসের সরবরাহ করা গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তবে সেখানে একটি রাইজার পাওয়া গেছে। যেটি অক্ষত রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের ঢাকা ও তার চারপাশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা পাইপলাইনের ৬০ শতাংশের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ বছরের পুরনো পাইপলাইনও রয়েছে। পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ এসব পাইপলাইনে ছিদ্র হয়ে প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত বিদ্যুৎ ও পানির লাইন স্থাপনের সময় এসব পাইপলাইনে ছিদ্র হয়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। এর সঙ্গে তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে গড়ে তোলা অবৈধ পাইপলাইনে ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব কারণে রাজধানী ও এর পাশর্^বর্তী এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই মাটির নিচ থেকে গ্যাস বের হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
২০১০ সাল থেকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি শিল্পকারখানায় গ্যাস সংযোগের ক্ষেত্রে নানারকম বিধিনিষিধের কারণে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা বেড়েছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিনের পুরনো এসব পাইপলাইন অপসারণের যেমন উদ্যোগ নেই, তেমনি এগুলো সংস্কারও করা হয় না। তিতাস গ্যাসের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে গ্যাস বের হয়ে যদি বাতাসে তার পরিমাণ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হয় তাহলে বিস্ফোরণ হতে পারে। এর পরিমাণ ২০ শতাংশের বেশি হলেই অগ্নিকা- ঘটে। এসব ক্ষেত্রে অল্প পরিমাণ আগুনের উপস্থিতি এমনকি বৈদ্যুতিক সুইচ পরিচালনার সময় স্পার্ক হলেও বড় ধরনের অগ্নিকা- হতে পারে।
বহির্বিশ্বে গ্যাসের পাইপলাইনে এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়। এতে কোথাও লিকেজ হলে দ্রত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে সাবধান হওয়া যায়। বাংলাদেশেও এ রাসায়নিক ব্যবহারের পাশাপাশি পাইপ লাইনের সংস্কার এবং গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রতিনিধিদের পর্যবেক্ষণ বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি। আগে থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমবে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এম আনসার হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অধিকাংশ ভবন তৈরির সময় এর নির্মাতারা গুণগত মানের চেয়ে কত কম খরচে বেশি টাকা আয় হবে সেই চিন্তা করেন। এখানে মানুষের জীবনের দাম আমলে নেওয়া হয় না। অথচ যেকোনো ভবন নির্মাণের সময় জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার সবার আগে।’
কিউটিভি/আয়শা/০৯ মার্চ ২০২৩,/বিকাল ৩:২১