
ডেস্ক নিউজ : বর্তমান বিশ্বে সামাজিক অস্থিরতা ও দ্বন্দ্বের অন্যতম প্রধান কারণ রাজনৈতিক বিরোধ ও প্রতিপক্ষের প্রতি রাজনীতিকদের সহিষ্ণু আচরণ। ইসলাম শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থান ও প্রতিপক্ষের প্রতি সৌজন্যমূলক আচরণের শিক্ষা দেয়। কেননা ইসলাম মত ও মতাদর্শের ভিন্নতাকে মানবসভ্যতার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মনে করে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে সব মানুষকে এক জাতি করতে পারতেন।
কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে। ’ (সুরা হুদ, আয়াত : ১১৮) রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা কাকে বলে? : ড. মারুফ রিহাল সহিষ্ণুতার পরিচয় তুলে ধরে বলেন, বিশ্বাস ও মতাদর্শ ভিন্ন হওয়ার পরও অন্যের প্রতি সৌহার্দ্য ও ন্যায়ভিত্তিক আচরণ করা। সে আচরণ ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সব কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে। এমনকি প্রতিপক্ষের বিশ্বাস, কাজ ও কর্মপন্থা ভুল মনে করলেও। (আত-তাসামুহুস সিয়াসি ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ৬)
কোরআনে সহিষ্ণুতার ধারণা : কেউ প্রতিপক্ষ হলেও কোরআন তার প্রতি সৌজন্যমূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। যেমন—
১. মানবিক মর্যাদা সবার প্রাপ্য : আল্লাহ জাতি, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষকে সম্মানিত করেছেন। তাই মানবিক মর্যাদা সব মানুষেরই প্রাপ্যা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি। তাদের উত্তম জীবিকা দান করেছি এবং আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের অনেকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। ’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৭০)
২. নির্বিবাদ প্রচার : কোরআন কারো সঙ্গে বিবাদে না জড়িয়ে নিজের আদর্শ প্রচারের পরামর্শ দিয়েছে এবং এমন কথা প্রচার করবে, যা ঐক্যের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা উত্তম পন্থা ছাড়া কিতাবিদের সঙ্গে বিতর্ক করবে না, তবে তাদের সঙ্গে করতে পারো, যারা তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী। আর বোলো, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা তাতে বিশ্বাস করি। আমাদের ও তোমাদের ইলাহ (উপাস্য) তো একই এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী। ’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৬)
৩. প্রতিপক্ষের প্রতি সুবিচার : কেউ রাজনৈতিক বা আদর্শিক প্রতিপক্ষ হলেও তার প্রতি সুবিচার করার নির্দেশ দিয়েছে কোরআন। যদি না তারা সরাসরি বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দ্বিনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি মহানুভব হতে এবং ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেননি। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন। ’ (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)
৪. ক্ষমতার পালাবদল কল্যাণকর : রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার বা ক্ষমতা ধরে রাখতেই সাধারণত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে নোংরা আচরণ করা হয়। কিন্তু কোরআনের ভাষ্যমতে কখনো কখনো ক্ষমতার পালাবদল কল্যাণ বয়ে আনে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ জগত্গুলোর প্রতি অনুগ্রহশীল। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৫১)
প্রতিপক্ষের উত্তর যেভাবে দেব : ইসলাম অন্যের সমালোচনার বিপরীতেও নগ্ন প্রতিক্রিয়া দেখাতে নিষেধ করে; বরং সমালোচনা ও কটূক্তির উত্তর প্রতিবিধানের নির্দেশ দেয়।
১. উত্তম প্রতিবিধান : প্রতিপক্ষের মন্দ আচরণের বিপরীতে উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেয় ইসলাম। ইরশাদ হয়েছে, ‘ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কোরো উত্কৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। ’ (সুরা হা-মিস-সাজদা, আয়াত : ৩৪)
২. নম্রতাই সুফল বয়ে আনে : ইসলাম সমালোচকের কঠোর আচরণ ও ভাষার বিপরীতে নম্র আচরণ করতে বলে। কেননা তাই সুফল বয়ে আনে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা উভয়ে নম্র ভাষায় কথা বোলো। হয়তো সে শিক্ষা গ্রহণ করবে অথবা ভয় পাবে। ’ (সুরা ত্বহা, আয়াত : ৪৪)
রাজনৈতিক শিষ্টাচার : ইসলাম মানুষকে কিছু রাজনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষার নির্দেশ দিয়েছে। যার কয়েকটি হলো—
১. অনুসন্ধান করা : প্রতিপক্ষের ব্যাপারে কোনো কথা শুনলেই তা যাচাই করে তা বিশ্বাস করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে। না হলে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বসবে এবং পরে তোমরা কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে। ’ (সুরা হুজরাত, আয়াত : ৬)
২. সংলাপ করা : প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংলাপ করা নবী-রাসুলদের বৈশিষ্ট্য। কোরআনে ইবরাহিম, মুসা ও নুহ (আ.)-সহ একাধিক নবীর সংলাপ বর্ণিত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি ফেরাউনের কাছে যাও, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে এবং বোলো, তোমার কি আগ্রহ আছে যে তুমি পবিত্র হও—আর আমি তোমাকে তোমার প্রতিপালকের দিকে পথপ্রদর্শন করি, যাতে তুমি তাঁকে ভয় করো? (সুরা নাজিয়াত, আয়াত : ১৭-১৯)
৩. সমঝোতা : রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই আরবের একাধিক গোত্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা করেছিলেন। যেমন মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে হুদাইবিয়ার প্রান্তরে সমঝোতা করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে মুশরিকদের মধ্যে যাদের সঙ্গে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ ও পরে যারা তোমাদের চুক্তি রক্ষায় কোনো ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তাদের সঙ্গে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ আল্লাহভীরুদের পছন্দ করেন। ’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৪)
৪. বিশৃঙ্খলার পথ পরিহার : বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে এমন কাজও পরিহার করা আবশ্যক। কেননা পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর অন্যায়। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২১৭)
৫. প্রতিপক্ষকে হেয় না করা : প্রতিপক্ষকে হেয় করা গুরুতর অন্যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে সে তার মুসলিম ভাইকে হেয় মনে করে। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৪৩৫)
আল্লাহ সবাইকে রাজনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করার তাওফিক দিন। আমিন
কিউটিভি/আয়শা/০১ সেপ্টেম্বর ২০২২,খ্রিস্টাব্দ/রাত ৮:১৪