
শাহীন সামাদ এর মুক্তির গান
———————————–
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৯ বছরের এক তরুণী রাস্তায় নেমেছে। তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ছে যুদ্ধ জয়ের গান। তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবোরে। আমরা ক’জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি, শক্ত করেরে। ভারতের রিফিউজি ক্যাম্পে, বাংলার যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে সেই তরুণী সুরের ঝংকার তুলতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতেন গানের সুরে সুরে। ”রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই নেব আমরা” অথবা “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে স্বাধীনতার উদ্যমী, জাগ্রত, শাশ্বত, গতিময় গানগুলো গেয়ে তাদের ক্লান্তি, ব্যথা ভুলিয়ে দিত সেই তরুণী। যা তাদের নতুনভাবে প্রেরণা জুগিয়ে আরো অপ্রতিরোধ্য, অসীম সাহসী হয়ে পাক হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করার প্রত্যয়ে অগ্রগামী করেছিল। এভাবেই এগিয়ে গিয়েছিল সে তরুণী দিনের পর দিন।
তরুণীর পথ শেষ হয়না। পথ থেকে পথে, বাংলাদেশ ভারতের পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ান তিনি। মাউথ অর্গান বাজান। একটি মিউজিক্যাল ব্যান্ডের সহযাত্রী সে। স্বপ্ন দেখে সেই তরুণী। একদিন দেশটা স্বাধীন হবে। মুক্ত বিহঙ্গ বলাকারা দল বেঁধে হারিয়ে যাবে দিগন্ত রেখায়। তরুণী আরও স্বপ্ন দেখে, বিজয়ের প্রভাতে, লাল সূর্যটা উঠার সাথে সাথেই খাঁচাটা খুলে দিতে হবে, প্রিয় ময়নাটাকে মুক্ত করে দিতে হবে।
এই তরুণী আর কেউ নন, তিনি শাহীন সামাদ। শাহীন সামাদ কেবল একজন নজরুল সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী ছিলেন না, ৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন কণ্ঠযোদ্ধা। স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিসেনারা যেমন অস্ত্র দিয়ে দুর্নিবার গতিতে পাকসেনাদের পরাজিত করেছিলেন, ঠিক তেমনি শাহীন সামাদ যুদ্ধ করেছেন কণ্ঠ দিয়ে। কণ্ঠকে হাতিয়ার বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছিলেন গানে গানে।
৮০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হলাম। জানলাম এই ডিপার্টমেন্টের সেলিব্রেটিদের কথা। শাহীন সামাদ, শাকিলা জাফর, ফাহমিদা নবী, আরও কত শিল্পীর নাম। এদের মধ্যে শাহীন সামাদের ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস। মনে মনে গর্ব অনুভব করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একই পরিবারের সদস্য।
৯১ সালের ডিসেম্বর মাসের এক মধ্যরাত। ব্যাংকক শহরের চাওফিয়া নদীর তীরে সিয়া ব্যান খায়েক এলাকার একটি এপার্টমেন্টে চলছে গোছগাছের পালা। আমি লাগেজ গুছাচ্ছি। দেশ থেকে আসার সময় ১১৭টি টিডিকে ক্যাসেট নিয়ে এসেছিলাম। ক্যাসেটগুলো এলিফ্যান্ট রোডের মিতালী থেকে রেকর্ডিং করা ছিল। সহযাত্রী বন্ধু সাঈদ আর অশোক বলছে, এত ক্যাসেট নেয়া যাবেনা। আরও তিনজন সিনিয়র বড় ভাই বললেন, কোরিয়ান ইমিগ্রেশন খুব কড়া, এত ক্যাসেট দেখলে তারা সন্দেহ করবে। ভিসা নাও দিতে পারে।
ভোর পাঁচটায় ডেল্টার ফ্লাইট। ব্যাংকক, তাইপে, সিউল হয়ে আমেরিকার ডেট্রয়েট। আমি নির্ঘুম রাত পার করে দিলাম ক্যাসেট সিলেকশনে। তিনটি ক্যাসেট নিতে পারব। মান্নাদে, শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও শাহীন সামাদের হারানো দিনের গানের ক্যাসেটটা নিলাম। শোন শোন কথাটি শোন। ফ্লাইট ধরার আগে ফ্ল্যাশব্যাকে আমি চলে যাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনে। ভোরের আজানের সাথেই ঘুম ভেঙে যায়। আধোঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় মিনি ক্যাসেট প্লেয়ার সানিওর প্লে বাটন টিপে দেই। ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে শাহীন সামাদ গেয়ে উঠেন, নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখিজল।
আমার বান্ধবী শারমিন গান বিশারদ। বিশেষ করে নজরুল গীতির উপর তার ব্যাপক ধারণা। শারমিন আমাকে বলে, নজরুল গীতি যদি শুনতে চাও তাহলে মানবেন্দ্র, ফিরোজা আর শাহীন সামাদের গান শুনবে। আমাকে সবক দিয়ে শারমিন ৩০ বছর যাবৎ আমেরিকায়। আর আমি এখনো শাহীন সামাদের গান শুনি।
শাহীন সামাদ আপা দর্শন বিভাগে আমাদের সিনিয়র, বড় বোন। আমরা একই পরিবারভুক্ত। ফেসবুকে মাঝে মাঝে আপার খোঁজ নেই। শত ব্যস্ততায় তিনি সাড়া দেন। উনাকে বুঝতে দেইনা, কি এক অদ্ভুত ভালোবাসা অনুভব করি তাঁর প্রতি। অন্তর থেকে তাঁর প্রতি সম্মানের ঝর্না ধারা বয়ে যায়।
মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের অভিপ্রায়ে এদেশের একদল সাংস্কৃতিক কর্মীর সঙ্গ নেন। বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা নামের দলের এই সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করতেন। এই শিল্পীদের সাথে থেকে লেভিন প্রায় ২০ ঘণ্টার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান। আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি ডকুমেন্টারি তৈরি করতে পারেননি। দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯০ সালে তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ নিউইয়র্কে লেভিনের কাছ থেকে এই ফুটেজ সংগ্রহ করেন। এরপরে মুক্তির গান মুক্তি পেল । আমরা দেখতে পেলাম মুক্তিযুদ্ধ ৭১ এর শাহীন সামাদকে।
এখনও ভোর হয়। কাকডাকা ভোরে আজান শুনি, আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম। ঘুম থেকে ফজরের নামাজ পড়ি। নামাজ শেষে আলো আঁধারীর মাঝে ইউটিউব অন করে দেই। আমার একজন বোন আছে, শাহীন সামাদ। কিন্নর, কৈশোরী কণ্ঠে তিনি গেয়ে উঠেন –
আমি ভাই ক্ষ্যাপা বাউল, আমার দেউল আমারি এই আপন দেহ।
আমার এ প্রাণের ঠাকুর নহে সুদূর অন্তরে মন্দির-গেহ।।
সে থাকে সকল সুখে সকল দুখে আমার বুকে অহরহ,
কভু তায় প্রণাম করি, বক্ষে ধরি, কভু তা’রে বিলাই স্নেহ।।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
কিউএনবি/বিপুল/২০.০৮.২০২২/ রাত ১১.৩৪