
ফিরে আসা
—————
হসপিটালে বসে আছি। আমার হাতে একটি ব্যাগ, ব্যাগে একটি সালোয়ার কামিজ, নরম সুতি ওড়না ও পানির বোতল। আমি একমনে দোয়া পড়ছি আর একটু পরপর পানি খাচ্ছি। একজন ডা. এসে আমার হাত থেকে পানির বোতলটি নিয়ে নিলেন। মুখে বললেন – মা, আপাতত পানি খাওয়া বন্ধ।
এমন সময়ে আমার নাম ঘোষনা করা হলো। আমি মৃদু পায়ে ডা.এর সাথে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলাম। অল্প বয়সী ডা. আমার হাতে ইঞ্জেকশন পুশ করতে করতে বলল – ভয় নেই মা। আমি ডা. এর কথায় এবং তার ভীত মুখ দেখে কোন ভরসা পেলাম না। একমনে বললাম – আল্লাহ্, আল্লাহ্, আল্লাহ্। খুব দূর থেকে কারা যেন কথা বলছে। তারা কি আমাকে নিয়ে বলছে ? নাকি নিজেদের মধ্যে কথা বলছে ঠিক জানি না।
একসময় তীব্র এক ব্যথার পাহাড় এসে আমার বুকে ধাক্কা দিতে লাগলো। ঘণ্টা বাজছে যেন কোথাও। কোথাও কি আগুন লেগেছে?
আমি একসময় বুঝতে পারলাম আমার পুরো শরীররের প্রতিটি কোণায় কোণায় তীব্র ব্যথার ঘণ্টা বেজে চলেছে। নিজের জানা সব সূরাগুলো পড়ে চলেছি।
কে যেন বলছিল, উনার সম্ভবত শ্বাসকষ্ট আছে । অক্সিজেন লেভেল বাড়াও। আমি যেন সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি। এই সময়ে সব পালটে গেল। দেখি দূরে দাঁড়িয়ে আছে আমার আব্বা, আম্মা। তাদের খুব চিন্তিত লাগছে। আমার ইচ্ছে হলো দৌঁড়ে গিয়ে আব্বার সাথে কথা বলি। জিজ্ঞেস করি – আব্বা তুমি কেন আমাদের এতো ছোট রেখে চলে গিয়েছিলে? আমরা তারপর কতো কষ্ট করেছি তুমি জানো ?
আম্মাকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল – আম্মা তুমি একবার একটা মসলিন শাড়ি আমাকে না কিনে দিতে পেরে কেঁদেছিলে। আজ আমার আলমারি ভর্তি শাড়ি আম্মা। কিন্তু এখন আর আমি পরতে পারি না। আমার বুকে ব্যথা আম্মা। ডা. আমাকে শাড়ি পরতে মানা করে দিয়েছেন। আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো। আম্মার লম্বা আঙুলগুলোতে চুমু খাই। একটা হিরের আংটি পরিয়ে দেখি কেমন সুন্দর লাগে। একবার ভাবলাম আম্মাকে বলি – ভাত খাইয়ে দাও আম্মা। কতোদিন তোমার হাতে ভাত খাই না। নতুন আলু দিয়ে দেশি মোরগ। অথবা আলু ডাটা দিয়ে চিংড়িমাছ।
মন চাইছিল । বাকি জীবনটা আম্মা আব্বার সাথে কাটিয়ে দেই। হঠাৎ পেছনে ফিরে দেখি। আমার সন্তান কাঁদছে। ওরা ওদের পবিত্র হাত তুলেছে আমার জন্য। ওরা ডাকছে আমাকে। আমি ব্যাকুল হয়ে ওদের কাছে আসতে চাই। আমার শরীর মনে হচ্ছে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। ওদের বুকের কষ্ট আমার কলিজায় এসে লাগছে। আমি শুধু বলি – আল্লাহ্ মুক্তি দাও। আল্লাহ্ আমার তো আর একটু দায়িত্ব আছে পৃথিবীতে। তুমি তো দয়ার সাগর, তুমি দয়া করো। আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল করে নিলেন।
কে যেন আমার কপালে হাত ছুঁয়ে বলছে। আপনি ভালো আছেন মা। আপনার অপারেশন খুব ভালো হয়েছে। আমি ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে আর একটি মানুষের কথা ভাবছিলাম। সে আমার স্বামী। আহা বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে তাকে। মাঝখানের সময়, বাবা মা, সন্তান সবাই আমার কাছে তুচ্ছ মনে হলো। আমি মানুষটাকে আরো বহুবার দেখার আশা নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
জ্ঞান ফিরে দেখি, আমার বড় মেয়ে আকুল নয়নে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার চোখ মেলা দেখেই সে সবার নিষেধ অমান্য করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কান্নার দমকে ওর ছোট্ট শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। বাবা, মা আর সন্তান এরা আসলে জীবন নদীর দুই পাড়ে থাকে। এদের মাঝখানে সেতু নামের জিনিসটি হলো স্বামী।
আল্লাহ্ আমাকে বাবা, মায়ের কাছে না দিয়ে সন্তানদের কাছে আবার ফিরিয়ে দিলেন। ওদের প্রতি এখনো হয়তো আমার অনেক দায়িত্ব আছে। আল্লাহ্র ইচ্ছা হয়তো সেইসব দায়িত্ব আমি নিজে পালন করি। শুকরিয়া হে আল্লাহ্ তোমার দরবারে আমি এবং আমরা এখন সুস্থ্য আছি।
( হে আল্লাহ্ আপনি তো ক্ষমাশীল )
কাল আমার ছোট্ট একটি অপারেশন হয়েছে। সবার কাছে দোয়া চাইছি। আল্লাহ্ যেন আমাকে এবং আমার মতো সমস্ত অসুস্থ্যদের নেক সুস্থতা দান করেন।
আমাদের কথাঃ কুইকটিভিবিডি.কমে ফেসবুক কর্নার নামে একটি নতুন বিভাগ চালু করা হয়েছে। প্রতিদিন ফেসবুক টাইমলাইনে অনেকেই জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে থাকেন। আমরা সে খন্ডচিত্র গুলোকে জোড়া দেয়ার চেষ্টা করছি। এখন থেকে ফেসবুক কর্নার নামের এই বিভাগে নিয়মিতভাবে অনেকের জীবনের খন্ডচিত্র তুলে ধরা হবে।
আজকে পাবনা’র নিতু ইসলাম এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পোস্টটি সংগ্রহ করা হয়েছে। তিনি নিয়মিতভাবে চমৎকার লেখনীর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক আবেগঘন পোস্ট উপহার দিয়ে থাকেন।
কিউএনবি/বিপুল/১৪.০৫.২০২২ খ্রিস্টাব্দ/ রাত ০১.০৬