
ডেস্ক নিউজ : ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল শেখ হাসিনার। এমন মনোবৃত্তি থেকেই দীর্ঘ শাসনামলে চালানো হয়েছে গুম-খুন কিংবা দমন-নিপীড়ন। কিন্তু ছাত্র-জনতার জোয়ারে ছাড়তে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর পদ। শেখ হাসিনার এই একচ্ছত্র শাসনের যবনিকা ঘটতেই আসতে থাকে শত শত অভিযোগ। এর মধ্যে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তিনি হতে পারেন সর্বোচ্চ সাজার মুখোমুখি। তবে, তাকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। এরই মধ্যে নিজের মক্কেলদের খালাসও চেয়েছেন তিনি।

শেখ হাসিনার এ মামলায় ৮৪ জনকে সাক্ষী করা হলেও ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন ৫৪ জন। তাদের সবাইকেই জেরা করেছেন আমির হোসেন। তার কয়েকটি জেরা আলোচনায় এসেছে দেশজুড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে এই আইনজীবীকে। এর মধ্যে ‘আবু সাঈদ হত্যার ভিডিও এআই দিয়ে বানানো’, ‘৫ আগস্ট পদত্যাগ করেননি শেখ হাসিনা’, ‘আন্দোলনকারীরাই লোকদের হত্যা করেছে’— দাবিটি অন্যতম। এছাড়া যুক্তিতর্কের দিনগুলোতেও তিনি আলোচনা-সমালোচনার খোরাক ছিলেন।

তথ্য বলছে, গত ৬ আগস্ট এ মামলায় চতুর্থ-পঞ্চম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিনা মুরমু ও এনটিভির রংপুর করেসপন্ডেন্ট এ কে এম মঈনুল হক। জবানবন্দিতে গত বছরের ১৬ জুলাই আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরের বর্ণনা দেন এনটিভির সাংবাদিক। একইসঙ্গে সেদিনের ভিডিও চিত্র তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু জেরার সময় প্রদর্শিত ফুটেজটি এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো বলে দাবি করেন আমির হোসেন। এছাড়া, ২১ সেপ্টেম্বর জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জেরার সময় শেখ হাসিনার পদত্যাগের কথা সামনে আনেন তিনি।
আমির হোসেনের ভাষ্যমতে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেননি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। জবানবন্দিতে দেওয়া নাহিদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে তিনি বলেছিলেন, ৩ আগস্ট সরকার পতনে ডাকা এক দফা কর্মসূচি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি ছিল। এ আন্দোলনের পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তির হাত ছিল বলেও দাবি করেন তিনি। যদিও তার এমন কথায় ওই দিন আপত্তি জানিয়েছেন প্রসিকিউশন। ঠিক এক দিন পরই আরেক সমন্বয়ক ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদকে জেরা করতে গিয়ে ‘আন্দোলনকারীরাই ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেছে’ বলে দাবি তোলেন তিনি।

৪৮তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেওয়া জুনায়েদকে জেরার একপর্যায়ে আমির হোসেন বলেছিলেন, কোটা সংস্কার সমাধানের জন্য যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা উপেক্ষা করে একের পর এক বেআইনি কর্মসূচি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। এছাড়া, আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বা ‘নাতিপুতি’ও বলেননি শেখ হাসিনা। তার কথার সঠিক অর্থ অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে ‘রাজাকার’ স্লোগান দিয়ে আন্দোলনকারীরা নিজেদেরই ছোট করেছেন। মূলত বৈধ সরকারকে উৎখাতের ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’-এর অংশ ছিল জুলাই আন্দোলন। জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল জড়িত ছিলেন না বলেও দাবি তার।

নিজের যুক্তিতেও শেখ হাসিনাকে ‘নিরপরাধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন আমির হোসেন। ‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোনো দুঃশাসন ছিল না’ উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালকে তিনি বলেছিলেন, দীর্ঘ ১৫ বছরে দেশে অকল্পনীয় পরিবর্তন এনেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সবচেয়ে বড় মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে রূপ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এরপরও তার সময়কালকে বলা হয় দুঃশাসন।
এছাড়া শেখ হাসিনাসহ কামালের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয় বলেও দাবি করেন এই আইনজীবী। কেননা, এসব প্রমাণে সক্ষম হয়নি প্রসিকিউশন। তাই এই দুই ফেরারি আসামির খালাস প্রত্যাশা করে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন জানান। তবে, যুক্তিতর্কের শুরুতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেন তিনি।

আসামিপক্ষের আইনজীবীর মতে, আইসিটি আইনে বিচার করা মানে আসামিকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দিয়ে সাঁতার কাটতে বলা। এমনকি যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম আরমানের একটি ভিডিওর প্রসঙ্গও টেনে আনেন। ওই ভিডিওতে নিজের বাবার বিচার চলাকালে এ আইন নিয়ে আরমানের কঠোর সমালোচনার সঙ্গেও একমত পোষণ করেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে আমির হোসেন বলেন, এ আইনে সিআরপিসি (CrPC) গ্রহণ করা যায় না। এখানে সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হওয়া উচিত ছিল। মূল এভিডেন্স অ্যাক্টও প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। এছাড়া, ইচ্ছামতো আইনটি সংশোধন করা হয়েছে।
একান্ত সাক্ষাৎকারে এ মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ মামলায় শেষের দিকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সাক্ষ্য হয়েছে। এর মধ্যে সবার শেষে জবানবন্দি দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর। একইসঙ্গে মারা যাওয়ায় আইনি বিধান অনুযায়ী বদরুদ্দীন উমরকে সাক্ষী হিসেবে এনেছে প্রসিকিউশন। এমনকি বিশেষ কিছু বিষয়ের ওপর সাক্ষ্য দিয়েছেন মামলার বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটর তানভীর হাসান জোহা। অন্যান্য সাক্ষীর পাশাপাশি তাদেরও জেরা করা হয়েছে। ফলে বেশকিছু তথ্য-উপাদান আমি আনতে পেরেছি। বিশেষত জোহা যেসব ডকুমেন্টারি আদালতে দাখিল করেছেন, সেসব নিয়ে আমার প্রশ্ন ছিল যে— এসব আর কোনো বিশেষজ্ঞ দিয়ে যাচাই করেছেন কি না। যা তারা করেননি। অতএব মনে করি এটা আমার পক্ষে।

জেরায় কী এমন উপাদান পেয়েছেন— যা আসামিরা মুক্তি পেতে পারেন; এমন প্রশ্নে আমির হোসেন বলেন, ‘কিছু কিছু তো পেয়েছি। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেভাবে নির্দেশদাতা বা তার মাধ্যমে ওয়াইড স্প্রেড অপরাধ হয়েছে; অর্থাৎ মূল নির্দেশদাতা হিসেবে তাকে এনেছে প্রসিকিউশন। আমি মনে করি তিনি এমন ঢালাওভাবে কোনো নির্দেশ দেননি। একটি আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে যতটুকু অস্ত্র অথবা যেসব আইনি বিধান রয়েছে, সেগুলো তিনি ব্যবহার করতে বলেছেন। যুক্তিতর্কেও প্রসিকিউশনের আনা এসব অভিযোগ বা বক্তব্যের বিরোধিতা করেছি। একইসঙ্গে আমার মক্কেলদের পক্ষে যুক্তি খণ্ডন করেছি। ফলে রায় আমার পক্ষে আসবে বলে আশাবাদী।

আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পেলেও শেখ হাসিনা-কামালের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই বলে দাবি তার। বলেন, ‘কেউই আমাকে কোনো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করেনি। কেউ যদি তথ্য দিত তাহলে আমার জন্য ভালো হতো। এরপরও আমি চেষ্টা করেছি। নিজের মেধা-বিদ্যা আর বুদ্ধি খাটিয়ে যতটুকু পেরেছি করেছি। আমি অনেক কিছু পারি, সেটাও স্বীকার করছি না। তবে, ভালোভাবে করার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি তা আমি জানি না। এছাড়া, আইনগতভাবে যোগাযোগের কোনো সুযোগ বা নিয়ম নেই। তিনি স্বেচ্ছায় এসে ধরা দিলে কেবলই যোগাযোগ করা সম্ভব।
রায় নিয়ে প্রত্যাশা কী— জানতে চাইলে আমির হোসেন বলেন, ‘আমি মনে করি আমার মক্কেলরা নির্দোষ। তাই আমি চাইব সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, দুজনই খালাস পাক। খালাস পেলেই আমি খুশি হবো। তবে খালাস যদি নাও পাই, তাতেও আমি মনে করব যে আইনি প্রক্রিয়া তথা লর্ডশিপ যেটা মনে করবেন সেটাই হবে। কোনো কারণে আমার পক্ষে রায় না এলেও আমি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি বা অন্যায়ের রায় হয়েছে— এমন ভাবাটাও ঠিক নয়। কারণ, আমি আদালতকে সহায়তা করেছি। লার্নেড কোর্ট (মাননীয় ট্রাইব্যুনাল) যে রায় দেবেন সেটাতে আমি মাথা পেতে নেব।’

‘আইনের নীতি হলো ১০টি প্রশ্ন বা ১০টি বিষয় যদি আসামির বিরুদ্ধে যায়, এর মধ্যে একটি পক্ষে থাকলেও তা জোরালো হবে। অর্থাৎ ১০টি উপেক্ষা করে এই একটি পয়েন্টের ওপরও আসামি খালাস পেতে পারেন। অতএব, সেক্ষেত্রে আমি এখনও নিরাশ নই। সত্যি কথা বলতে যে আমার জন্য এটা একটা নতুন মামলা। এই প্যাটার্নের মামলা আগে কখনও করিনি। এক্ষেত্রে শুরুতে আমাকে কিছু প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়েছিল। কারণ, যে প্যাটার্নের মামলা করে আসছি আমার মাথায় ওইটাই কাজ করে। এখানে আসার পর দেখা যায় যে আইনগতভাবে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সেসব বাধা অতিক্রম করে আমাকে এগোতে হয়। অতএব, আমার পথটা অত সহজ নয়।’

‘২০১৩ সালে সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষকেও আপিলের অধিকার করে দেয় তৎকালীন সরকার। ফলে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী ও কার্যকর হয়। পরে এই আইন ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা দেখা দেয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সেই আইনেই ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের প্রভাবশালী সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের। তাই, রাষ্ট্রনিযুক্ত বা শেখ হাসিনার আইনজীবী এ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও আইনগত ভিত্তি পাচ্ছেন না। কারণ, আইনটি সংশোধিত হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকা সরকারের আমলেই।’
আয়শা/২২ অক্টোবর ২০২৫,/বিকাল ৩:১৯