
ডেস্ক নিউজ : এক বছর আগেও ক্ষমতার চূড়ায় ছিলেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি— সবই চলত তার হুকুমে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। এরপর তার বিরুদ্ধে দায়ের হয় অসংখ্য মামলা। দীর্ঘ শাসনামলে গুম-খুন, দুর্নীতি, গণহত্যাসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার রায় হতে যাচ্ছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এ মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে— জানিয়েছে ট্রাইব্যুনাল সূত্র।
মানবতাবিরোধী অপরাধের ওই মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও আসামি করা হয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য-জেরার পর শেষ হয়েছে প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক। স্টেট ডিফেন্সের যুক্তিতর্ক শেষ হলেই রায়ের তারিখ নির্ধারণ করবেন ট্রাইব্যুনাল। চলতি সপ্তাহে স্টেট ডিফেন্সের যুক্তিতর্ক ও প্রসিকিউশনের যুক্তি খণ্ডন শেষ হতে পারে। সেই হিসাবে ২৩ অক্টোবরের পর পাওয়া যাবে রায়ের দিনক্ষণ।
প্রসিকিউশনের তথ্যমতে, শেখ হাসিনার এ মামলায় মোট ৮৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তবে, রাজসাক্ষীসহ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্য দিয়েছেন ৫৪ জন। এর মধ্যে চাক্ষুষ সাক্ষী সাতজন, আহত ভুক্তভোগী দুজন, ভুক্তভোগীর পরিবারের আটজন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সাতজন, আহতদের চিকিৎসক সাক্ষী তিনজন এবং জব্দ তালিকার সাক্ষী রয়েছেন ১৪ জন। সাংবাদিক হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন একজন। ময়নাতদন্তকারী একজন, ঘটনার সমর্থন সাক্ষী দুজন, রাজসাক্ষী একজন, বিশেষ তদন্তকারী একজন ও মূল তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে একজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট, বিশেষজ্ঞ, ওয়ারল্যাস বার্তার সাক্ষী হিসেবে একজন করে; ফরেনসিক, ঘটনার পটভূমির সাক্ষী হিসেবে দুজন করে জবানবন্দি দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে।

সর্বশেষ ১৬ অক্টোবর টানা পাঁচদিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। শেখ হাসিনাকে সব অপরাধীর ‘প্রাণভোমরা’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন তিনি। তবে, হাসিনা-কামালের সর্বোচ্চ সাজা চাইলেও রাজসাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেওয়া মামুনের শাস্তির বিষয়টি আদালতের ওপর ছেড়ে দেন চিফ প্রসিকিউটর। ফলে সাবেক এই আইজিপিকে দণ্ড নাকি ক্ষমা করা হবে, এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা।
ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, যুক্তিতর্কে এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগই প্রমাণ করেছে প্রসিকিউশন। কারণ, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনার মধ্যে ওয়াইড স্প্রেড (বিস্তৃত) ও সিস্টেম্যাটিক (পদ্ধতিগত) অপরাধ ছিল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এসব অপরাধ ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটি হিসেবে চিহ্নিতযোগ্য। এছাড়া, শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ নির্দেশ ও নেতৃত্বেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন দমনে পুলিশ, বিজিবি, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থাসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এতে ১৪০০-এরও বেশি মানুষ নিহতের পাশাপাশি হাজারও ছাত্র-জনতা আহত হন। সবমিলিয়ে এসব অপরাধের দায়ে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা তথা মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘শেখ হাসিনা বা তার দলের শাসন-ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতেই এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। কমান্ড স্ট্রাকচারের শীর্ষে বসে তিনি নিজেই হুকুম দিয়েছিলেন। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার, হেলিকপ্টার থেকে গুলি-বোম্বিংসহ নানাভাবে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন সরকারপ্রধান হিসেবে। তার বিভিন্ন ফোনালাপে এসব জিঘাংসা মনোবৃত্তি উঠে এসেছে। যুক্তিতর্কে আদালতের কাছে আমরা সেসব ফোনালাপসহ নানা তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছি।’
তিনি বলেন, “হাসিনা ও কামাল, কারও ক্ষেত্রেই মিটিগেটিং ফ্যাক্টর নেই। বরং সবগুলোই এগ্রাভেটিং ফ্যাক্টর, যা সর্বোচ্চ দণ্ড নিশ্চিতের পক্ষে যুক্তি দেয়। কারণ, প্রধান আসামি শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের নিউক্লিয়াস। এমনকি এত সব অপরাধেও তার কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো তিনি ‘হার্ড-নাট ক্রিমিনাল’ হিসেবে আচরণ করছেন। ভারতে বসেও নানা আস্ফালন দেখাচ্ছেন। এছাড়া, কমান্ড স্ট্রাকচারে দ্বিতীয় পজিশনে ছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। তাই তাদের ব্যাপারে চরম দণ্ড চাওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালে।”
মামলার কার্যক্রম নিয়ে তিনি বলেন, চলতি সপ্তাহে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবীর যুক্তিতর্ক ও প্রসিকিউশনের খণ্ডনের পর্ব সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর কতদিন লাগবে তা তিনিই বলতে পারবেন। সেক্ষেত্রে চলতি সপ্তাহ বা এ মাসের বাকি দিনগুলো লাগতে পারে। এরপর রায়ের জন্য দিন ধার্য করবেন ট্রাইব্যুনাল। এখানে প্রসিকিউশনের কোনো এখতিয়ার নেই।
অন্যদিকে, নিজের মক্কেলরা খালাস পাবেন বলে আশাবাদী শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার মক্কেল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলা হয়েছে নির্দেশদাতা। প্রসিকিউশনের পক্ষে নির্দেশদাতা হিসেবে আনলেও আমি মনে করি ঢালাওভাবে তিনি নির্দেশ দেননি। একটি আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করতে হলে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই করেছেন। আইনি বিধান হিসেবেই তিনি সবকিছু করার নির্দেশ দিয়েছেন।’
লেথাল ওয়েপন বা মারণাস্ত্র ব্যবহার প্রসঙ্গে আমির হোসেন বলেন, ‘একটি ভিডিও দিয়ে লেথাল ওয়েপনের যে কথাটা বলা হচ্ছে, এই ভিডিও সঠিকভাবে করা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। এটা এআই দিয়ে তৈরি বলে আমি মনে করি। তবে, সাক্ষীদের জেরায় যেসব উপাদান পেয়েছি তা আমি যুক্তিতর্কে উপস্থাপন করব। আমি হতাশ নই। আশা করি আমার মক্কেলদের মুক্ত করতে পারব। তবে, যুক্তিতর্কের পর আরও ভালো বলা যাবে।’
দুই ধাপে শুনানি শেষে তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়। ১০ জুলাই এ আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল। এ মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার।
আয়শা/২০ অক্টোবর ২০২৫,/বিকাল ৫:১২