
আইন আদালত’র রেজাউর রহমান : চোখের আলোয় দেখেছিলাম চোখের বাহিরে—
——————————————————————-
দুদিন আগের এক সন্ধ্যায় কানাডা থেকে ফোন করলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয় অনুজ খন্দকার ইসমাইল। টিভি ব্যক্তিত্ব, টিভি পারফর্মার, উপস্থাপক খন্দকার ইসমাইল কেন ফোন দিয়েছে নিমিষেই বুঝে গেলাম। কানাডা প্রবাসী খন্দকার ইসমাইল মেনিটোভা থেকে একটি অনলাইন বাংলা টিভি Chanel 6 Teen সম্প্রচার ও পরিচালনা করেন। প্রবাসী হলেও সে তার জাত কর্ম বন্ধ রাখেনি। ব্যতিক্রমধর্মী এক টকশো নিয়মিত উপহার দিয়ে থাকে সে।
বিটিভির প্রথিতযশা প্রযোজক খ ম হারুনের জীবন কথন নিয়ে আড্ডা অনুষ্ঠানে প্রসঙ্গক্রমে আইন আদালত খ্যাত উপস্থাপক রেজাউর রহমানের প্রসঙ্গ উঠলে আমি টকশো লাইভ অনুষ্ঠানটির ফেসবুক পেজে একটা কমেন্টস করি। ঐ কমেন্টস বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ইসমাইল জানায়, ভাইয়া আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান রেজাউর রহমান। আমি সম্মতি জানালে কিছুক্ষন পরেই কানাডার অটোয়া থেকে ফোন করেন ৮০’র দশকে বিটিভির সাড়া জাগানো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান আইন আদালতের নন্দিত উপস্থাপক রেজাউর রহমান। কথা হলো আধাঘন্টা ব্যাপী হোয়াটস্যাপ এ।

রেজাউর রহমান।
আইন আদালত অনুষ্ঠানটি ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত বিটিভিতে সম্প্রচারিত হয়। সে সময় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বলতে ফজলে লোহানীর ”যদি কিছু মনে না করেন” ঢাকা উত্তরের সাবেক প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের ”অন্তরালে” এবং তারুণ্যের উদ্দীপনায় ভরপুর এক স্মার্ট যুবক রেজাউর রহমান এর ”আইন আদালত” অনুষ্ঠান তিনটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল। দেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভির এই অনুষ্ঠান গুলো সম্প্রচারের সময় ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা ফাঁকা দেখা যেত। মানুষ ঘর মুখ হতো এই অনুষ্ঠানগুলো দেখার জন্যে।
রেজাউর রহমান আইন আদালত অনুষ্ঠানটি করতে যেয়ে বাংলাদেশের একজন সেলিব্রিটি মানবাধিকার কর্মী হয়ে ওঠেন। তিনি মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য বিশাল ঝুঁকি নিয়েছিলেন। একজন তরুণ আইনজীবী হিসেবে, তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই এবং মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিতে তার ভূমিকার জন্য জাতির আস্থা অর্জন করেছিলেন সেই মুহূর্তে।

রেজাউর রহমান।
১৯৫৭ সালে জন্ম নেয়া রেজাউর রহমান একজন শহীদ পরিবারের সদস্য। হোয়াটস্যাপ এ কথা প্রসঙ্গে রেজাউর রহমান অনেক কথার মাঝে তার আপন চাচা শহীদ বুদ্ধজীবী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শহীদ শামসুজ্জোহার প্রসঙ্গ টানলেন বেদনার্ত কণ্ঠে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ ছাত্রদের জন্যে তাঁর নামে একটি আবাসিক হল ”জোহা হল” করে সম্মান প্রদর্শন করেছেন। ড.শামসুজ্জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন অধ্যাপক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালনকালে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন তিনি। ড.শামসুজ্জোহাকে দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে গন্য করা হয়। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।
রেজাউর রহমান জানালেন অন্তরে আদর্শিক সাহসী চেতনা তৈরী করতে পেরেছি আমার চাচা ও বাবা এবং পরিবারের কাছ থেকেই। আমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। তিনি আমাদের গড়ে তুলেছিলেন দেশের জন্যে। সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে শুরু করেছিলাম আইন আদালত অনুষ্ঠানটি। প্রাণনাশের হুমকি ও ভয় ভীতি উপেক্ষা করে সেই সময়ে যে সত্যকথা গুলো মিডিয়ায় উচ্চারণ করেছিলাম তা বোধ হয় চিরকালীন সত্য।
রেজাউর রহমান আমাকে একটি গল্প শোনালেন। বিটিভির আইন আদালত অনুষ্ঠান নিয়ে। বরিশালের কুখ্যাত এক ডাকাত পরবর্তীতে স্বীয়স্বার্থ অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিল ও স্বাধীনতার পরে পূর্ব শত্রূতার কারণে তার প্রতিপক্ষ একটি পরিবারের দুই ভাইয়ের চোখ উপড়ে ফেলেছিলো। মুক্তিযোদ্ধা বিধায় তাকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় ক্ষমা করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এই অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়েছিল সেই সময়I তৎকালীন সরকার কুদ্দুস মোল্লাকে ক্ষমা করে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু এই প্রতিবেদনটি প্রচারিত হওয়ার পর জনগণ প্রবল ভাবে সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে
তিনি আমাকে বললেন, মনে রাখবেন তখন কোনো নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় ছিলনা আর সরকারি গণমাধ্যম, বাংলাদেশ টেলিভিশন ছাড়া আর কোনো টিভি চ্যানেল ছিলোনা I….. আমার প্রশ্ন, আজ কি কোনো কুখ্যাত অপরাধীকে রাষ্ট্রপতি অন্যায় ভাবে ক্ষমা করলে কোনো টিভি চ্যানেলে এই ভাবে কেউ বলতে পারবেন ?

রেজাউর রহমান।
আমি জবাবে বললাম, মিডিয়া এখন টাকাওয়ালাদের টাকা রক্ষার ঢাল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই কালচারটি বর্তমান সরকারের আমলেই পরিণত রূপ লাভ করেছে। মিডিয়ার স্বাধীনতা বাদ দিন, যেদেশে এখন গণতন্ত্র, ভোটাধিকার অবরুদ্ধ সেখানে মিডিয়া কার্যক্রমতো আরও বেশি অবরুদ্ধ হবে।
এরশাদ জমানার কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে রেজাউর রহমান বললেন, চোখের আলোয় আমরা অনেক কিছু দেখি। কিন্তু চোখের দেখার বাহিরেও কিছু অদৃশ্য বাস্তবতা থাকে তা কিন্তু আমরা দেখতে পাইনা। কিন্তু অদৃশ্য সেই বাস্তবতা কিন্তু মিথ্যা নয়। ভাল কিছু সৃষ্টির পিছনে সৎ নিয়ত থাকলেও সৎ কর্মকান্ড চলমান রাখা খুব কঠিন কাজ। যেমন আমিও পারিনি জনস্বার্থে প্রচারিত আইন আদালত অনুষ্ঠানটিকে কন্টিনিউ করতে। তৎকালীন সরকারের রোষানলে শুধু আইন আদালতই বন্ধ হয়নি, পথ শিশুদের কল্যানে আমার বেসরকারী প্রতিষ্ঠানটির মূলভাবনা পরিকল্পনা সাংগঠনিক কাঠামো ছিনতাই করে সরকারিভাবে সৃষ্টি করা হয় ”পথকলি ট্রাস্ট”।
রেজাউর রহমান একজন আইনজীবী হিসাবে কানাডাতে কাজ করছেন। তিনি অন্যায় মোকাবিলা এবং মানবাধিকারের প্রোফাইল উত্থাপন করেছিলেন। কানাডিয়ান মিডিয়া তাকে চিত্রিত করেছে এবং কানাডার ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ড দ্য অ্যাসাইলাম ডকুমেন্টারিতে। ১৯৯৪-৯৫ সংস্করণের ”হুইজ হু অফ দ্য ওয়ার্ল্ডে” তার নাম ছিল।

রেজাউর রহমান।
তিনি কানাডার অটোয়াতে ক্যাথলিক ইমিগ্রেশন সেন্টার এবং লেবানিজ আরব সোশ্যাল সার্ভিসের গ্রাহকদের বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দেন। রহমান কমিউনিটি সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং ব্লগে অবদান রাখেন এবং কানাডিয়ান নাগরিকত্ব ও অভিবাসন আইনের বিষয়ে সংগঠন ও গোষ্ঠীতে বক্তব্য রাখেন।
একজন প্রবাসী রেজাউর রহমানের দুঃখ বেদনা কষ্টের কথা শুনে আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। খন্দকার ইসমাইলের টকশো আড্ডার জীবন কথনে আমি যে কমেন্টসটি করেছিলাম রেজাউর রহমানকে নিয়ে তা ডিলেট করে দিলাম। আসলেই সত্য, চোখের দেখার বাহিরেও কিছু নির্মম সত্য লুকিয়ে থাকে। এক কষ্টভরা মন নিয়ে ইউটিউব অন করে শুনতে লাগলাম রবীন্দ্র সংগীত —
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে॥
ধরায় যখন দাও না ধরা হৃদয় তখন তোমায় ভরা,
এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহিরে॥
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।
নাহিদা /২২.০৭.২০২৩/ দুপুর ১.৪৫