
জল জোসনা’র হুমায়ূন আহমেদ
————————————–
১১ বছর আগে, আজকের এই দিনে বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, খ্যাতিমান জনপ্রিয় কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। আজ তাঁর ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী, ২০১২ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দেখতে দেখতে ১১টি বছর কেটে গেল। হুমায়ূন বিহীন আমাদের জীবন জল জোসনাবিহীন এক জীবন যেন।
১১ বছর আগে আজকের এই দিনে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু সংবাদে দেশের মানুষের মাঝে বিষাদের ছাঁয়া নেমে এসেছিল এক নিমিষেই। শুধু বাংলাদেশেই নয়,বিশ্বের তাবৎ বাংলাভাষা ভাষীদের মাঝে দেখা যায় ভিন্ন এক আহাজারি। মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন ফুঁটিয়ে তুলতে যিনি অকৃপণ হাতে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।
১১ বছর আগে, আজকের এই দিনে হুমায়ূন আহমেদ এর মৃত্যু সংবাদ লাইভ প্রকাশ করছিল দেশের সকল স্যাটেলাইট টিভিগুলো। রুদ্ধশ্বাসে টিভির পর্দায় দেশের মানুষ দেখতে পাচ্ছিল ভিন্ন এক দৃশ্য। হুমায়ূন আহমেদ এর ঢাকার বাসায় ছুটে আসছে হুমায়ুন আহমেদ এর ভাই বোন,সন্তান, আত্মীয় স্বজন, পাঠক গুনগ্রাহী সহ অসংখ্য জনতা। কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকা থেকে লাশ আসছে হুমায়ূন আহমেদ এর। স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন অনড়। তিনি চান, হুমায়ূন আহমেদ এর লাশ দাফন করা হবে তাঁর স্বপ্নের অনবদ্য সৃষ্টি নুহাশ পল্লীতে। কেউ কেউ চায় অন্য কোথাও। এই জটিলতা অবশেষে দূর হয়। সিদ্ধান্ত আসে চূড়ান্ত ভাবে, নুহাশ পল্লীতেই চীর নিদ্রায় শায়ীত হবেন হুমায়ুন আহমেদ।
১১ বছর পর নূহাশ পল্লীতে আজ মানুষের ঢল নেমেছিল। কথার যাদুকর হুমায়ূন আহমেদ এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে হাজারও হিমু গিয়েছিল আজ হুমায়ূন আহমেদ এর কবরে। লালপেড়ে সাদা শাড়ি পড়া রূপাদের চোখ ছিল নোনাজলে সিক্ত। শ্রদ্ধা, দোয়া, মাগফেরাত কামনায় আজ নূহাশ পল্লী ছিল ভিন্নরকম।
১১ বছর আগে ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশে নানা অনুষ্ঠানে তার ভক্ত-শুভার্থীরা কামনা করেছিলেন তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন বাংলাদেশে। তবে মানুষের সেই প্রার্থনা পূরণ হয়নি। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। হুমায়ূন নেই কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে।
১১ বছর যাবৎ বাংলা ভাষা ভাষী লক্ষ কোটি পাঠক কাটাচ্ছে জল জোসনাবিহীন, হুমায়ূন বিহীন এক অন্যরকম সাহিত্যাঙ্গনে। চলচ্চিত্র,টিভি নাটক সংগীতাঙ্গন কোথায় নেই আজ তাঁর জন্যে আহাজারি ? পাঠককে বইমুখী করতে এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কলমের খোঁচায় হাসিকান্না,দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনার এক কাব্যভূমি রচনা করেছিলেন তিনি।
১৯৭২ সালে প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পরপরই হুমায়ূন আহমেদ এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। উপন্যাসে ও নাটকে তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো বিশেষ করে ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ রূপা তরুণ-তরুণীদের কাছে হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। জনপ্রিয়তার জগতে তিনি একক ও অনন্য।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ২৩ জুলাই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় হুমায়ূন আহমেদের লাশ। ২৪ জুন তাকে দাফন করা হয় তার গড়ে তোলা গাজীপুরের নুহাশপল্লীর লিচুতলায়।তার জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে। ডাকনাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা আর মা গৃহিণী। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়।
তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্যামল ছায়া’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’ ও ‘নয় নম্বর বিপদসংকেত’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ প্রভৃতি। বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৯৪ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) লাভ করেন।
বাংলাদেশে এখনও বর্ষা আসে। এই বর্ষায় ছইওয়ালা নৌকায় মাইক বাজিয়ে নববধূ চোখের নোনাজলে চলে যায় ভিন্ন এক গাঁয়ে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে আম গাছের মগডালে বসে গান ধরে, একটা ছিল সোনার কন্যা, মেঘবরণ কেশ, ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ–অথবা ছলাৎ ছলাৎ বৈঠা চালিয়ে হাওর পাড়ি দেয়া মাঝির কণ্ঠে দরদের সুরে বের হয়ে আসে, পুবালী বাতাসে, আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে।
জল জোসনার এই বাংলাদেশে সব কিছুই আছে। নেই শুধু হুমায়ূন আহমেদ। কথার যাদুকর, কথামালার রূপকার হুমায়ূন আহমেদ এর প্রাণ পাখি আজ ভিন্ন এক জগতে, না ফেরার দেশে। হুমায়ুন আহমেদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে কেউ যদি গেয়ে উঠে –
ও আমার উড়াল পঙ্খীরে যা যা তুই উড়াল দিয়া যা
আমি থাকব মাটির ঘরে, আমার চোক্ষে বৃষ্টি পরে
তোর হইবে মেঘের উপরে বাসা।
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।
নাহিদা/১৯.০৭.২০২৩/ রাত ১১.৩০