ডেস্ক নিউজ : রহমত, বরকত, মাগফিরাত এ তিনের সমন্বয়ে সজ্জিত পবিত্র মাহে রমজান। আমলের অনুশীলন ও তাকওয়া অর্জনের মাস। এ মাসেই মুমিনের পৃথিবী সেজে উঠে নেক আমলের আধিক্যে। মাহে রমজান ও তাকওয়ার মাঝে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। কেননা, রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তিকে অবশ্যই তাকওয়ার গুনাবলি অর্জন করতে হয়। বছরের এক মাসব্যাপী সিয়াম পালনের উদ্দেশ্য নিছক উপবাস থাকা নয়, এর মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। তাই মুসলমানদের তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে মাহে রমজানের পূর্ণাঙ্গ একটি মাস রোজা পালন করা ফরজ করা হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদের প্রতি, যাতে করে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।’ (সুরা বাকারা:১৮৩)
তাকওয়ার আভিধানিক অর্থ
‘তাকওয়া’ এটি আরবী শব্দ। এর মূল অর্থ হলো শংকিত বিষয় থেকে কোন জিনিসকে হেফাজত করা বা কষ্টদায়ক ও ক্ষতিকর বিষয় থেকে কোন জিনিসকে সংরক্ষণ করা।
তাকওয়ার পারিভাষিক অর্থ
উলামায়ে কেরাম তাকওয়ার অনেক সংজ্ঞা বর্ননা করেছেন। তন্মধ্যে হতে এখানে কয়েকটি সজ্ঞা তুলে ধরা হলো-
১. শায়েখ আব্দুল আজীজ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বায রহ. বলেন-
শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর ভয়ে, তার এবং রাসুল সা.এর মুহাব্বতে ও জান্নাতের আশায় সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার বর্জন করে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী আল্লাহর ইবাদত করার নামই তাকওয়া।[আত্তাকওয়া:৯]
২. শায়েখ আব্দুল্লাহ আত্তানুসী রহ. বলেন-
নির্দেশিত বিষয়গুলোকে মানা ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলোকে বর্জন করার নামই তাকওয়া।[বাসাইরু যায়ীত্তামীজ:৫/২৫৭]
৩. ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ (রহ.) বলেন- আল্লাহতায়ালা যা কিছু হারাম করেছেন, সেগুলোকে বর্জন করা এবং যা কিছু ফরজ করেছেন সেগুলোকে পালন করার নামই তাকওয়া। (আত্তাকওয়া:১০)
৪. ইমাম রাগিব আল ইসফাহানী (রহ.) বলেন- শরিয়তের পরিভাষায় যাবতীয় গুনার কাজ থেকে নফসকে হেফাজত করার নামই তাকওয়া। (আল মুফরাদাত:৫৩০)
জনৈক বিজ্ঞ আলিম বলেন- আল্লাহকে ভয় করা, কুরআন অনুযায়ী আমল করা, অল্পতে তুষ্ট থাকা ও পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার নামই তাকওয়া। (আত্তাকওয়া: ১১)
তাকওয়ার স্থান অন্তর
তাকওয়ার স্থান ও অবস্থান হলো অন্তর। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে তা বর্ননা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরের বিষয়ে বিশেষ অবগত। (সুরা মায়েদা:৭)
রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার উপর যুলুম করে না এবং তাকে সঙ্গীহীন ও সহায়হীনভাবে ছেড়ে দেয় না। সে তার কাছে মিথ্যা বলে না ও তাকে অপমান করে না। তাকওয়া হচ্ছে-এখানে, তিনি নিজের বুকের দিকে ইশারা করেন। (মুসলিম:২৫৬৪)
ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করা
ইবাদত-বন্দিগীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, আল্লাহর কাছে পৌঁছেনা এগুলোর গোশত ও রক্ত; বরং তার কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। (সুরা হজ্জ:৩৭)
তাকওয়া অর্জনের উপায়
কুরআন-সুন্নায় তাকওয়া অর্জনের অনেক উপায় বর্ননা করা হয়েছে। তন্মধ্যে এখানে কয়েকটি উপায় উল্লেখ করা হলো-
১. আল্লাহতায়ালার যথাযথ পরিচয় লাভ করা
কোন মুসলমান যদি পবিত্র কুরআনকে ভালোভাবে বুঝতে পারে তাহলে পবিত্র কুরআন তার অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করবে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয় আমি এ কোরআনে মানুষের জন্য সব দৃষ্টান্তই বর্ননা করেছি, যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে। বক্রতামুক্ত আরবী কুরআন,যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে। (সুরা যুমার: ২৭-২৮)
পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা সিয়ামের বিধিবিধান বর্ননা করার পর বলেন, এভাবেই আল্লাহ তার আয়াতসমূহ মানুষের জন্য বিস্তারিত বর্ননা করেন, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে। (সুরা বাকারা:১৮৭)
আল্লাহতায়ালার পরিচয় লাভ করার অনন্য এক মাধ্যম হলো পবিত্র কুরআন। কোন মানুষ যখন পবিত্র কুরআন নিয়ে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা করে,তখন আল্লাহতায়ালা তার শান-শওকাত, মহত্ব, তার গুণবাচক নামসমূহ ও গুণাবলীর মাধ্যমে তার সামনে প্রকাশ হন।
২. ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করা
আল্লাহতায়ালার ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, চাই সেটা ফরজ ইবাদত হোক কিংবা নফল।
এরশাদ হচ্ছে, হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সুরা বাকারা:২১)
যে সমস্ত ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়, তন্মধ্যে একটি ইবাদত হলো ‘সিয়াম’। আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সুরা বাকারা:১৮৩)
সুতরাং যদি তাকওয়া অর্জন না হয়,তাহলে সিয়ামের মাকসাদ আদায় হবে না। ফলে সিয়ামের সওয়াব কম হবে। (আল ফাতওয়া আল মিসরিয়াহ:২৮৯)
৩. আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা
আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করার মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয় রাত ও দিবসের বিবর্তন এবং আসমানসমূহ ও যমীনে যা আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, তাতে বহু নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে। (সুরা ইউনুস:৬)
৪. পরকাল ও তার ভয়াবহতা বিষয়ে আয়াত ও হাদিস পাঠ করা
কবর ও তার আযাব এবং পরকাল ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কৃত কুরআনের আয়াত ও হাদিসগুলো বেশি বেশি অধ্যয়ন করার মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি হয়।
আল্লাহতায়ালা বলেন, তাদের জন্য তাদের উপর দিকে থাকবে আগুনের আচ্ছাদন আর তাদের নিচের দিকেও থাকবে (আগুনের)আচ্ছাদন; এ দ্বারা আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভয় দেখান। হে আমার বান্দারা! তোমরা আমাকে ভয় কর। (সুরা যুমার:১৬)
লেখক: এমফিল গবেষক, আল আযহার ইউনিভার্সিটি কায়রো, মিসর
কিউটিভি/আয়শা/৩রা এপ্রিল, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ/বিকাল ৫:০৯