
সাহিত্য ডেস্ক : আমাদের সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ব্যাপক ও গভীর। মূলত ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রথম সুসংহত প্রকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে সংঘবদ্ধ করে তুলেছিল, দিয়েছিল সংগ্রামের অবিনাশী প্রেরণা। মাতৃভাষা হরণের ষড়যন্ত্র বাঙালির অস্তিত্ব-সংকটে রূপ নিয়েছিল। কারণ মাতৃভাষা বাংলাকে বাঙালি অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ জ্ঞান করে। তাই মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য সংগ্রাম ও রক্তদান অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের কবিতায় ভাষা আন্দোলন বা একুশের চেতনা গভীর দ্যোতনাময়।
বাঙালি যে শুধু ক্রন্দন-বিলাসী নয়, প্রয়োজনে সংগ্রামও করতে জানে, বুকের রক্তে রঞ্জিত করতে পারে রাজপথ, তা এ কবিতায় চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অসামান্য সংকলনটি প্রথম প্রকাশিত হয়, তা হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ (১৯৫৩)। শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গনি হাজারী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখের লেখা সংকলনটিতে স্থান পায়।
ভাষা আন্দোলন শামসুর রাহমানকে তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছিল। মূলত ভাষা আন্দোলন প্রসূত রাজনৈতিক উত্তেজনা শামসুর রাহমানকে উদ্দীপিত করেছিল। তিনি নিজস্ব মনোজাগতিক আবরণ ছিন্ন করে বহিঃপৃথিবীর প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ধর্মীয় বোধে অন্ধ ছিলেন না বলেই তিনি বাংলাভাষাকে নিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্মম ষড়যন্ত্রকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তার কবিতায় বাংলাভাষার প্রতি যেমন মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি বাংলাভাষাকে নস্যাতের পাকিস্তানি নীলনকশার বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ ঘোষিত হয়েছে। ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতায় তারই প্রতিধ্বনি শোনা যায়-‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?…/এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,/এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তিখেউড়ের পৌষ মাস!/ তোমার মুখের দিকে আর যায় না তাকানো/ বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’ কবির প্রিয় বর্ণমালার অবমাননায় তিনি মর্মাহত। তার হতাশা, যন্ত্রণা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিমালায়। উনিশশ বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে সংঘটিত রক্তাক্ত ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় তার বেশ কিছু কবিতায়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের মিছিল; পাকিস্তনি পুলিশের নির্মম গুলিবর্ষণ; সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতের আত্মদান শামসুর রাহমানের কবিতায় ভিন্নমাত্রিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত। ভাষা আন্দোলনে নিহত শহিদদের স্মৃতি নানাভাবে ঘুরে ফিরে এসেছে তার কবিতায়। আল মাহমুদের (১৯৩৬) কবিতায়ও ভাষা শহিদদের প্রসঙ্গ নিপুণভাবে উঠে এসেছে-
‘ ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।’
কৃষ্ণচূড়ার ডাল ও শহিদের রক্তের লাল রঙের সামঞ্জস্য খোঁজার প্রবণতা একুশের কবিতায় দারুণভাবে লক্ষযোগ্য। আমাদের দেশের সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি বেশ তাৎপর্যবহ। এখানে সবুজ অদম্য প্রাণশক্তির প্রতীক আর লাল কৃষ্ণচূড়া সংগ্রামী চেতনার সমান্তরাল হয়ে ওঠে। শামসুর রাহমানের ভাষায়-‘একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।’ হাসান হাফিজুর রহমান ভাষাশহিদদের নামের মধ্যেও খুঁজে পেয়েছেন বর্শার ফলার তীক্ষ্নতা। থোকা থোকা নামের এ শহিদদের ব্যক্তিগত জীবনালেখ্য কবির অনুভবের তীব্রতায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে-সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার-কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম/ এই এক সারি নাম বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে।’
ভাষা আন্দোলনে আত্মদানকারী শহিদদের মমতাময়ী মায়ের গর্ব ও সন্তান হারানোর বেদনা একাকার হয়ে উঠেছে বেশ কিছু কবিতায়। সন্তানের ফটোগ্রাফই হয়ে ওঠে শহিদ জননীর একমাত্র অবলম্বন। সেই ফটোগ্রাফই যেন এক জ্বলজ্বলে ইতিহাস।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক কবিতাগুলোতে কয়েকটি প্রবণতা সহজলক্ষ। প্রথমত এই শ্রেণির কবিতাগুলোতে বাংলাভাষা ও বাংলা বর্ণমালার প্রতি কবির গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। দ্বিতীয়ত একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনাবলির উল্লেখ। তৃতীয়ত ভাষা আন্দোলনে আত্মদানকারী শহিদদের স্মৃতি-রোমন্থন এবং চতুর্থত ভাষা-শহিদ জননী বা শহিদ স্বজনদের ব্যক্তিগত শোকের রূপায়ণ। তবে সব কিছুকে ম্লান করে এ শ্রেণির কবিতাগুলোতে প্রধান হয়ে ওঠে কবির একুশের চেতনাজাত পরিশুদ্ধ স্বদেশবোধ। কবি যখন একুশের ঘটনাবলির কাব্য-ভাষ্য নির্মাণ করেন তখন তিনি ঘটনা থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান না করে ঘটনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠেন। রফিক, বরকত, সালাম, কিংবা জব্বারের স্বপ্ন কবির স্বপ্নের সমান্তরাল হয়ে ওঠে। তাদের ভাষাপ্রেম, আত্মদান কবির আকাক্সক্ষারই বাস্তবতায় রূপ নেয়। তাই এ কবিতাগুলো এত বেশি মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে; হয়ে ওঠে ভাষা আন্দোলনের প্রাণবন্ত উৎসারণ। এ দেশের ফুল, পাখি, বৃক্ষ কিংবা নিষ্প্রাণ পরিপার্শ্ব থেকেও কবিরা বাংলা বর্ণমালাকে জেগে উঠতে দেখেন।
ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এরপর আর বাঙালি জাতিকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দেশ, ভাষা ও স্বাধিকারের দাবিতে তারা একের পর এক আন্দোলন-সংগ্রামে বীরদর্পে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শহিদ মিনার ভাষাশহিদদের স্মৃতিময় স্তম্ভ। এ শহিদ মিনার শুধু নির্জীব স্তম্ভই নয়, বাঙালির গৌরবময় ও সংগ্রামী ইতিহাসের প্রতীকও বটে। ভাষা আন্দোলনে নিহত শহিদদের স্মরণে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলে পাকিস্তানি শাসকচক্র তা ভেঙে ফেলে। এর প্রতিবাদে উচ্চকিত হয়ে ওঠে এ দেশের সংগ্রামী জনতা। কারণ শহিদ মিনার বাঙালির ভাষাপ্রেম, আত্মমর্যাদা ও স্বাধিকার বোধেরই মূর্তমাণ রূপ। আলাউদ্দিন আল আজাদ শহিদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে রচনা করেন ‘স্মৃতিস্তম্ভ¢’ কবিতাটি। এ কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেন এই অমর শ্লোক-
‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো
চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে ভিত কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে’
শহিদ মিনার বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পটভূমি হিসাবেও শহিদ মিনার ভিন্ন মাত্রিক ব্যঞ্জনা তৈরি করে। শহিদ মিনারে কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে শামসুর রাহমান বলেন-‘আমাদের কবিতা পাঠের সময়/ মনে হয়/ তাঁরা এলেন শহীদ মিনারে, নিঃশব্দে কিছুক্ষণ/ আসা-যাওয়া করে চত্বরে কজন/ শহীদ দাঁড়ান পাদপীঠে। নিমেষে শস্যক্ষেত্র হয়ে যায় / শহীদ মিনার, তাঁরা কাহাতশাসিত দেশের শস্যের মতো/ দুলতে থাকেন ক্রমাগত।/ তারপর তাঁরা সবকিছু ছাপিয়ে ওঠেন, এমন দীর্ঘকায়।’ শহিদ মিনারে কবিতা পাঠের আসরে শহিদদের উপস্থিতির পরাবাস্তব (surrealistic) চিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির উজ্জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ভাষাশহিদদের নিত্য উপস্থিতির বাস্তবতাকেই অতিলৌকিক চরিত্রে দাঁড় করায়। ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তারা মৃত্যুঞ্জয়ী। যত দিন বাংলাভাষা থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন তারা বেঁচে থাকবেন। কবিতায় একুশের চেতনা ও ভাষাশহিদদের সরব উপস্থিতি এ সত্যকেই গভীর দ্যোতনায় উচ্চকিত করে তোলে।
কিউটিভি/আয়শা/২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩/সন্ধ্যা ৬:২৪