
ডেস্ক নিউজ : গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়ম ও দায়িত্ব পালনে অবহেলার দায়ে ১৩৪ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ তালিকায় আছেন এক রিটার্নিং, এক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), এক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ১২৬ প্রিসাইডিং, ৫ পুলিশ কর্মকর্তা। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দু-একদিনের মধ্যে চিঠি দেবে ইসি। কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো তা এক মাসের মধ্যে ইসিকে জানাতে হবে।
এর ব্যত্যয় হলে সেই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন কমিশন। বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। এদিনের সভায় ওই নির্বাচনের প্রার্থী, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারের (এসপি) বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তাদের শাস্তির কথা বলা হয়নি। এছাড়া ভোটের দিন যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে সেখানে কেন্দ্র এজেন্টদের তালিকা তৈরি করা হবে। ভবিষ্যতে এরা (এজেন্ট) কোনো নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এ সাজার কথা জানিয়ে সিইসি বলেন, ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনে অনিয়ম হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ধারায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, গাইবান্ধা-৫ আসনে ভোটগ্রহণের নতুন তারিখ আগামী সপ্তাহে ঘোষণা করবে কমিশন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, দুজন ছাড়া বাকিদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫ অনুযায়ী নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেবে ইসি সচিবালয়। বাকি দুজনের বিরুদ্ধে অন্য ধারায় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয় উল্লেখ করে চিঠি দেওয়া হবে। দুজনের মধ্যে একজন ৯৪ নম্বর কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা স্থানীয় উদয়ন ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মো. সাইফুল ইসলাম। তাকে চাকরি থেকে দুই মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সরাসরি নির্দেশ দেওয়া হবে। আর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অবৈধ আদেশ পালন করায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হবে। নির্দিষ্ট শাস্তির কথা উল্লেখ করে আলাদাভাবে চিঠি দুটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
নির্বাচনের ইতিহাসে অনিয়মের অভিযোগে পুরো ভোট বন্ধ এবং এত সংখ্যক কর্মকর্তাকে সাজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত সাহসী পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, এমন নজির এটাই প্রথম। ইসির এমন সিদ্ধান্ত খুবই ভালো। এর আগে একটি নির্বাচনে এত সংখ্যক ব্যক্তিকে কখনো শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিজ নিজ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেবে। ওই চিঠি অনুযায়ী সরকার কী ব্যবস্থা নেয় সেটাই দেখার বিষয়। সরকার ব্যবস্থা না নিলে নির্বাচন কমিশনকেই পদক্ষেপ নিতে হবে।
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে গত ১২ অক্টোবর ভোট হয়। সিসি ক্যামেরায় অনিয়মের দৃশ্য দেখে প্রথমে ৫১ কেন্দ্র, পরে পুরো নির্বাচন বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয় ইসি। ওই ঘটনায় দুই ধাপে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটি। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী ইসি এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, গাইবান্ধার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুশান্ত কুমার সাহা, এক রিটার্নিং কর্মকর্তা, ১২৬ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও ৫ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের দায়ে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ৫ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিতে যাচ্ছে ইসি সচিবালয়।
ওই ধারায় বলা আছে-কোনো নির্বাচন-কর্মকর্তা নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে কমিশন বা ক্ষেত্রমত রিটার্নিং অফিসারের কোনো আদেশ বা নির্দেশ পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যর্থ হলে বা অস্বীকৃতি প্রকাশ করলে বা নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো আইনের বিধান ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করলে বা এর অধীন কোনো অপরাধ করলে তিনি অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে। এটি তার চাকরি বিধি অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এ অপরাধে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত করতে পারবে বা বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারবে বা তার পদাবনতি বা পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি অনধিক দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখতে পারবে। নির্বাচনি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও প্রার্থী, ডিসি ও এসপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন।
এ বিষয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। কোনো প্রার্থীর পক্ষে অপরাধ সমর্থনে সুস্পষ্ট কোনো প্রমাণ পাইনি। তাছাড়া কার পক্ষে ভোট পড়েছে তা আমরা জানি না। অনুমাননির্ভর কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আইনের চোখে সমর্থনযোগ্য নয় বলে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেইনি। তিনি বলেন, এসপি-ডিসির বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অবহেলার বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আসেনি। কারণ তারা ভোটকেন্দ্রের ভেতরে যাননি, তারা বাইরে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভোটকেন্দ্রের বাইরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো ছিল। কাজেই তাদের দায়ী করা যায় না।
যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন ইসির রাজশাহীর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার বিষয়ে সিইসি বলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা অনিয়ম প্রতিরোধের চেষ্টা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। একটি কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ ঘোষণা করে দায়িত্ব পালনের প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তিনি যথাযথ দায়িত্ব পালন করলে ব্যাপক অনিয়ম প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ৫ অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ইসি সচিবকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ১২৬ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে, পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং এডিসি ও একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে।
আর ৯৪ নম্বর কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামকে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৫(৩) অনুযায়ী চাকরি থেকে ২ মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করার জন্য বলা হবে। সিইসি বলেন, এক মাসের মধ্যে কর্তৃপক্ষ দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনকে অবহিত না করলে ওই কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৬(২) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভোটের নতুন তারিখ : প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, পুনর্ভোটের তারিখ আগামী সপ্তাহে জানানো হবে। খুবই সংক্ষিপ্ত একটি সময় দেওয়া হবে। ভোটের একটি দিন দিয়ে পুনর্ভোটের সময় জানানো হবে। তিনি জানান, কবে ভোট হবে ও কারা দায়িত্বে থাকবেন তা পরে জানানো হবে। সব প্রার্থী আগের মতোই থাকবে।
কিউটিভি/আয়শা/০২ ডিসেম্বর ২০২২,খ্রিস্টাব্দ/দুপুর ১২:২৮