
চুঁচুড়া থেকে চিনসুরা : কত পথ গিয়ে মিশে–
—————————————————
সমগ্র ভারত বর্ষের মধ্যে প্রথম উপনিবেশিক শহর বা নগরের নাম চুঁচুড়া। যা এখন পশ্চিম বংগের হুগলী জেলার প্রানকেন্দ্র। প্রায় ৫৫০ বছর পুর্বে চুঁচড়া শহরের গোড়াপত্তন ঘটে। সে ক্ষেত্রে কোলকাতা শহরের গোড়াপত্তন ৩০০ বছর পুর্বে হলেও চুঁচড়া কোলকাতার থেকে আরও ২৫০ বছরের প্রাচীন শহর।
চুঁচুড়ার উপনিবেশিবাদের ইতিহাসে প্রায় ৮/১০ টি জাতির আবির্ভাব ঘটেছিল। এরমধ্যে পর্তুগীজ, ফিরিংগি, ওলন্দাজ, আর্মেনীয়, ফরাসী ও ডাচ অন্যতম।
উপনিবেশক স্থাপন করার জন্য অন্যান্য জাতির সাথে ডেনমার্কের লোকেরা এসেছিলো। পুর্তুগীজরা এই উপমহাদেশে এনেছিল পেয়ারা , টমেটো,আলু, পেঁপে l আর শিখিয়ে ছিল বিস্কুট, কেক, পেস্ট্রি ইত্যাদি খাওয়া। যা উপমহাদেশের খাদ্য তালিকা থেকে আর বাদ দেয়া যায়নি l
চুঁচুড়া নগরীর গোড়াপত্তনে সবচেয়ে বেশী ভুমিকা রেখেছে পর্তুগীজরা। তাদের সৃস্ট ইমারত গুলো এখনো স্বগর্বে দাঁড়িয়ে আছে।
চুঁচুড়া শব্দটি পর্তুগীজরা উচ্চারন করতে পারতনা। তারা বলত Chinsurah.
চুঁচুড়া থেকে ৫ কিমি দূরে প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক নদী বন্দর “আদিসপ্তগ্রাম ” l আদিসপ্তগ্রামের ৩ কিমি দূরে ব্যান্ডেল অঞ্চল l যেখানে ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিতীয় খ্রিস্টান গির্জা, প্রথমটি গোয়াতে।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাজী মুহাম্মদ মোহসিন দানবীর চুঁচুড়াতে স্থাপনা করেন মাদ্রাসা, কলেজ, ইমামবাড়া। হাজী মুহাম্মদ মোহসিন ১৮৩৬ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করেন “হুগলী মোহসিন কলেজ”, এরও আগে এখানে ১৮১৭ সালে হুগলী মাদ্রাসার যাত্রা শুরু হয়।
আরবীয়, ইরানী,মধ্যপ্রাচ্যের স্থাপত্য রীতিতে আজ বিস্ময় তাঁর সৃষ্টিগুলো। আর ইমামবাড়া হাসপাতাল যা আজ হুগলী জেলা সুপার ফেসিলিটি সরকারি চিকিৎসালয় হিসাবে স্বীকৃত।
মো্হসিন কলেজের প্রতিষ্ঠা লগ্নের ছাত্র ছিলেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাধ্যায়। এখান থেকে পাশ করেই তিনি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট এর দায়িত্বও পালন করেন হুগলীতে। ছাত্রাবস্থায় তিনি কলেজের সম্মুখে বিকেডি ছাত্রাবাসের ছাত্র ছিলেন।
মোহসিন কলেজের ছাত্রাবাসের নাম KLD হোস্টেল বা কানাই লাল দত্ত নামের ছাত্রাবাস ll এখানে সঙ্গীত শিল্পী থেকে সকলই পড়াশুনা করতেন l শ্যামল মিত্র মোহসিন কলেজের ছাত্র ছিলেন, চুঁচুড়া মাঠে অদ্বিতীয় গোলরক্ষক ছিলেন lকানাইলাল অগ্নিযুগের লড়াইয়ে সাহসী একজন তরুণ l জেলখানায় বিশ্বাসঘাতক নরেন গোসাইকে হত্যা করেন তিনি l বিচারে কানাই লাল দত্তের ফাঁসি হয়। মোহসিন কলেজের আরও একটি হোস্টেল আছে। জাকারিয়া হোস্টেল, এটি মুসলমান ছাত্রদের জন্য।
এই শহরে শিক্ষাবিদ সাহিত্যিক নবজাগরণের হোতা ভূদেব মুখোপাধ্যায়, শ্ৰেষ্ঠ বাগ্মী রামগোপাল ঘোষ, সাহিত্যিক অক্ষয় সরকার, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রায়গুণাকর ভারত চন্দ্র রায়, রঙ্গলাল মুখোপাধ্যায়। বঙ্কিম চন্দ্রের ছাত্র জীবন ও কর্ম জীবন কেটেছে এখানে l
রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, শ্রীরামকৃষ্ণ। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, বিপ্লবী জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ, হামিদুল হক, সিরাজুল হক, এই শহর ও জেলার মানুষ l
চুঁচুড়া ঊনবিংশ শতকের রেনেসাঁর আতুর ঘর l যা সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ,ধর্ম সংস্কার, বিদ্যালয় স্থাপন, নারীমুক্তি আন্দোলন, ডিরোজিওর নব্য ভারত ও ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট, কংগ্রেসের সুতিকা গৃহ, বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোধা এই শহর। প্রথম বাংলা ছাপা খানার গৌরব এই শহরের মুকুটে। হাওড়া- হুগলী রেলপথটি ভারত উপমহাদেশে দ্বিতীয় রেলপথ l
প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করে কাজী নজরুল ইসলাম চুঁচুড়া শহরে বসবাস শুরু করেন। চুঁচুড়া জেলে কাজী নজরুল কারাবাস বরন করেন। কাজী নজরুল ইসলাম দুটি গান জেলখানায় বসে লেখেন। এই শিকল পড়া ছল মোদের এই শিকল পড়া ছল, আর দ্বিতীয়টি কারার এই লৌহ কপাট।
কলেজের সন্নিকটে ছিল মান্নাদে’র মামা বাড়ী। এই কলেজের ছাত্র না হলেও মান্নাদে কলেজের সম্মুখ মাঠে দাপিয়ে খেলাধুলা করেছিলেন।
মোহসিন কলেজের ছাত্র ছিলেন সংগিত শিল্পি সতিনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র। আমার ভাল লাগার প্রিয় মানুষগুলোর চারণভূমি ছিল চুঁচড়ার এই মোহসিন কলেজ।
মান্নাদে’র মামাবাড়ী ডিঙ্গিয়ে মোহনা গঙ্গোপাধ্যায় দি’র বলরাম গলির বাড়িটি। এই পথ গুলোতে আজ হেটেছি অনেক। এই পথের মাঝেই হয়ত শ্যামল মিত্র গেয়ে বেড়াতেন, জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখ হিসাব নিকাশ —-
তথ্যসুত্রে: ড. সংকেত গাংগুলি। লেখাটি লিখেছি ৭.০৬.২০২২ রাত ৪.১৫টায় নৈহাটী থেকে শিয়ালদহ রেল স্টেশনে আসার পথে ট্রেনে বসে।
পোস্টদাতা ও লেখকঃ লুৎফর রহমান। তাঁর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পোস্টটি সংগৃহিত। তিনি রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
কিউএনবি/বিপুল/১১.০৬.২০২২/ রাত ১১.৫৫