ব্যাংকক জীবনের উপাখ্যান : পর্ব-৯, থার্টিফার্স্ট নাইট ইন সিউল

admin | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২২ - ০৬:১৭:৩৫ পিএম

থার্টিফাস্ট নাইট। সিউলের জমকালো রাতের এ শহরে আমরা বের হয়েছি চার যুবক। নতুন বছরকে বরন করার সকল প্রস্তুতি নিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া ও এর রাজধানী সিউল বাসী। রাস্তায় যুবক যুবতী ছাড়াও সব বয়সের মানুষেরা বেড়িয়েছে। মাতাল মানুষের সংখ্যাও কম নয়। সিউল শহরটাও ব্যাংককের মত নদী দিয়ে দুভাগে বিভক্ত। সিউল শহরটার মাঝ বুক চিরে বয়ে গেছে হাংগাঙ্গ নদী। আমাদের অবস্থান হাংগাঙ্গ নদীর উত্তর সাইডে।

সাঈদ, অশোক আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ”বিটুসান” ওরফে ওয়াহিদুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েনি। কিন্তু দুই নম্বরীতে যদি কোন বিশ্ববিদ্যালয় থাকতো তাহলে বিটুসান সে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হতে পারত। ইংরেজি বর্ণমালার B যেমন দ্বিতীয় বা দুই নম্বর, তেমনি সংখ্যার ২ নিয়ে নাম ধারণ করা ”বিটুসান” ডাবল দুই নম্বর। দুই নাম্বারীর হেন্ কোন ফর্মুলা নেই যা তার অজানা। আমার আজকের কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র এই ”বিটুসান”।চলুন ঘুরে আসা যাক বিটুসানকে নিয়ে সিউলের এই জমকালো রজনীতে।

ইয়কসাম ডং এ একটা রেস্টুরেন্টে আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। এই রেস্টুরেন্টে মাত্র একটা আইটেম পাওয়া যায়। চিকেন ফ্রাই। বিভিন্ন সস দিয়ে মাখানো এই চিকেন ফ্রাইয়ের স্বাদ এখনো জিহবায় লেগে আছে। আমরা বাইরে থেকে কেনা পাউরুটি আর চিকেন ফ্রাই খেয়ে বের হলাম সিউলে থার্টিফার্স্ট নাইট দেখার জন্যে।

একটা ইয়েলো ক্যাবে আমরা উঠে পড়লাম। বিটুসান ড্রাইভারকে মিটার চালু করতে নিষেধ করল। সারারাত সে আমাদের নিয়ে ঘুরাবে, তাকে ১০ মাংক দেয়া হবে। ড্রাইভার সানন্দে রাজি হল। ১০ হাজার ওন এ ১ মাংক হয়। তখন ১ মাংক মানে ১২ ডলার। সারারাতে ট্যাক্সি ড্রাইভার পাবে ১২০ ডলার। মন্দ নয় এমন ট্রিপ।

আমরা পুরো সিউল শহর ঘুরলাম। মাইনাস সেভেন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মাঝেও সমগ্র সিউল শহর গমগম করছে। আলোর ঝলকানিতে ভেসে যাচ্ছে সব। তুষার পাতের জন্যে পুলিশ বেশি তৎপর। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে কেউ পরে থাকলে হিমশীতল তুষারে তার মৃত্যু অবধারিত। আমরা যেমন হিন্দি বুঝতে ও কিছুটা বলতে পারি, তেমনি কোরিয়ানরা জাপানিজ ল্যাংগুয়েজ বুঝতে ও বলতে পারে। দীর্ঘদিন বিটুসান জাপানে ছিল। জাপানিজ ভাষায় ”সান” মানে সাহেব। অর্থাৎ বিটু সাহেব।

ইয়কসাম ডং থেকে আমরা সিটি হলে আসলাম। সিটি হল আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের ন্যায় আইন প্রণয়ন কেন্দ্র। হাজার হাজার মানুষ এখানে সমবেত হয়েছে। এখানে বর্ষ বরণের মাহাত্বই আলাদা। রাত ১১.৫৫ মিনিটে আমাদের ট্যাক্সি কোরিয়ানা হোটেলের পার্কিংএ পার্ক করলাম। এখান থেকে সিটি হলের সুউচ্চ বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। আমরা সিটি হলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি । একটু পরেই আমরা ১৯৯২ সালে প্রবেশ করলাম। সিউলের আকাশ আতশবাজিতে ভরে গেল। বর্ষবরণ শেষে আমরা আবারো ট্যাক্সিতে উঠলাম। এবারে আমাদের গন্তব্য হাংগাঙ্গ নদী। এই নদীর উপরে সব মিলিয়ে ৮৮টি ব্রিজ আছে। এর মধ্যে কয়েকটি সাবওয়ে ব্রিজ।

ইয়েলো ক্যাবে মাউথ পিস্ সহ হ্যান্ড মাইক আছে। ছোট এই মাইকের হর্ন ট্যাক্সির ছাদে ফিক্সড করা। আমরা কোরাস গাইতে গাইতে হাংগাঙ্গ নদীর দিকে যাচ্ছি। আমাদের সম্মিলিত গণসংগীতে রাস্তার অন্যান্য গাড়ীর লোকজন মজা করে আমাদেরকে দেখছে। আমরা গাইছি, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। আমাদের ট্যাক্সি পৌঁছে গেল হাংগাঙ্গ নদীর কাছে। আমরা ট্যাক্সি থেকে নেমে কনকনে এ শীতে হাংগাঙ্গ নদীর তীরে বসলাম।

সিউল শহরের সমস্ত আলো যেন ঢলে পড়েছে হাংগাঙ্গ নদীতে। নয়নাভিরাম সে দৃশ্য। নিকটবর্তী ব্রিজ দিয়ে শা শা করে গাড়ী গুলো দ্রুত নদীর বুকচিরে পার হচ্ছে। গাড়ীর লাইটগুলো তির্যকভাবে নদীর পানিতে ঢেউ খেলছে। অপরূপ সে দৃশ্য। নদীর কাছাকাছি নেমে দেখলাম, একটা সামান্য কাগজের টুকরো নেই পানিতে। কোরিয়ানরা অসম্ভব যত্ন নেয় এই নদীর। হাংগাঙ্গ নদী আমাদের বুড়িগঙ্গার চেয়ে অনেক প্রশস্ত আর গভীর।

মধ্যরাতে এক কফিশপে আমরা কফি খেতে খেলাম। আমাদের সাথে ট্যাক্সি ড্রাইভারও কফি খেল। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের জিজ্ঞাসা করল, আগাসি ইছয়ও ? এর অর্থ হল তোমাদের কোন যুবতী বান্ধবী আছে কিনা ? বিটুসান কোরিয়ান কোরিয়ান ভাষায় জবাব দিল, আগাসি অপসোয়ও, মুঞ্জে অপসোয়ও। আমাদের বান্ধবী নেই , আমাদের কোন সমস্যাও নেই। ট্যাক্সি ড্রাইভার মনে হয় একটু হতাশ হল।

আমরা ফিরছি আমাদের হোটেলের দিকে। বিটুসান আমাদেরকে বলল,একটু পরে আমি একটা ঘটনা ঘটাব। আপনারা চুপচাপ থাকবেন। কোন কথা বলবেন না। আমরা সকলে অবাক হয়ে বিটুসানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কি ঘটনা ঘটাতে চায় বিটুসান ?

ভোরবেলা আমাদের হোটেলের পাশে এক পুলিশ বক্সের কাছে ট্যাক্সি থামাল বিটুসান। ১০ মাংকের পরিবর্তে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে সে মাত্র ১ মাংক ভাড়া দিল। ড্রাইভারতো আকাশ থেকে পড়ল। সারারাত ভাড়া খেটে মাত্র ১ মাংক ? এই টাকা ১০ কিঃমিঃ এর ভাড়া মাত্র । ড্রাইভার গাড়ী থেকে নেমে হাউকাউ শুরু করতেই বিটুসান ড্রাইভারের কানে কানে পুলিশ বক্স দেখিয়ে বলল, কিয়ংসাল ইছোয়ো। এর মানে হল, এখানে পুলিশ আছে। বিটুসান ড্রাইভারকে আরও বলল, ব্যাটা বাড়াবাড়ি করলে পুলিশকে বলে দেব, তুমি মিটার ছাড়া ভাড়া ক্লেইম করছ। বিটুসান আমাদেরকে নিয়ে হোটেলের পথে হাঁটতে লাগল। ট্যাক্সি ড্রাইভার ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

ছবিঃ ১. হাংগাঙ্গ নদীর রাতের দৃশ্য। ২. সিউলে ৯২ সালের বর্ষ বরণ মুহূর্তে গোল চিহ্ন দেয়া বিটুসান সহ সাঈদ,অশোক ও আমি।৩.সিউল শহরে রাতে বর্ষবরণের আতশবাজি। ৪. সিউলে ইয়েলো ক্যাব।

লেখকঃ লুৎফর রহমান। লেখক, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ।

 

 

বিপুল/ ১৯শে এপ্রিল, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ |সন্ধ্যা ৬:১১

▎সর্বশেষ

ad