আমার চলে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। টিকেট কনফার্ম হয়েছে। এবার বিদায়ের পালা। আমিন ভাই সিউলে থাকতে থাকতেই আমি সিউলে যেতে চাই। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে আমার সকল বন্দোবস্ত উনিই করে দিবেন। আপাততঃ শেষবারের মত ফাওরাতে এটা আমার শেষ দিন। দুপুরে দুলাল ভাই, বড়ভাই,সাঈদ সোহরাব, অশোক সহ আমরা মিতালীতে লাঞ্চ করলাম। লাঞ্চ করতে করতে অনেক কথা বললেন বড়ভাই ।
বিদেশে অবৈধ লেবার হওয়ার জন্যে আমাদের জন্ম হয়নি। রেস্টুরেন্টে পিঁয়াজ কাটা,বাসনকোসন মাজার জন্যে আমরা জন্মিনি। পরিস্থিতির কারণে আমরা যেকোন ভাবেই হোক উত্তরণের জন্যে লড়াই করছি। কিন্তু মাথায় একটা জিনিষ গেঁথে রাখবে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কর্ণধার হওয়ার জন্যে আমাদের জন্ম হয়েছে এবং সেটা যেকোন মূল্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিদেশে সেটল্ড করার কথা স্বপ্নেও ভাববে না। খেতে খেতে বড়ভাই আমাকে উদ্যেশ্য করে কথা গুলো বললেন। তিনি বললেন, একটা পরিচয় সব সময় মনে রাখবে, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সন্তান।
আমি চলে যাব। দুলাল ভাই তার হাত থেকে গোল্ডেন কালারের হাত ঘড়িটি খুলে আমাকে দিলেন। কয়েকদিন আগে দুলাল ভাইর ছোটভাই জাপান থেকে এ ঘড়িটি পাঠিয়েছে। অনেক দামি ঘড়ি। বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪০ হাজার টাকা দাম। আমি ঘড়িটি হাতে দিলাম। লাঞ্চ করে বান্টিতে আসলাম। দুলাল ভাইর স্ত্রী, আমাদের নীলম ভাবী আমাকে ডেকে বললেন, মেরে সাথ এটিএম মে চলো। ভাবী আমাকে নিয়ে এটিএম মার্কেট থেকে টি শার্ট আর জিন্স প্যান্ট কিনে দিলেন। একগাঁদা উপদেশ দিলেন। কোরিয়ান লাড়কিকো সাথ কোই রিস্তা মাত কর। তোমকো ব্যাংককমে জরুর ওয়াপাস আনা পরেগা। ভাবীর কথা শুনে আমি আড়ালে চোখ মুছি।
রাতে শুরু হল আমার ল্যাগেজ গোছগাছ। কিন্তু সমস্যায় পড়লাম ঢাকা থেকে নিয়ে আসা প্রায় ৭০টি টিডিকে ক্যাসেট নিয়ে। সবগুলো ক্যাসেটে প্রিয় শিল্পীদের গান রেকর্ড করা। এই ক্যাসেট নিয়ে কি বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম ঢাকা এয়ারপোর্টে, মনে পড়ে যাওয়ায় হাসি পাচ্ছে আমার। সেদিনের কথা মনে পড়ল আমার।
১৯৯১ সালের ১৩ই অক্টোবর ।দেশ ছেড়ে পালাচ্ছি আমরা। দুদিন আগেই সাঈদ সোহরাব ও অশোক চলে গেছে। তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে আমি আর কাঞ্চন ভাই খুব দ্রুত ঢুকে পড়লাম। এমনিতেই আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। থাই এয়ারলাইন্স এর কাউন্টার ক্লোজ করে দিচ্ছে। সিকিউরিটি চেকিং চলছে আমাদের। লাগেজ স্ক্যানিংয়ে আমার ব্যাগ আটকিয়ে দেয়া হল। আপনার ব্যাগে এত ক্যাসেট কেন ? প্রায় ৭০টি টিডিকে রেকর্ডিং ক্যাসেট।
কাঞ্চন ভাই আমার উপর তেড়ে উঠল, ওই মিয়া এত ক্যাসেট নিছ ক্যান ? তুমি কি গান শোনার জন্যে বিদেশ যাচ্ছ? কাঞ্চন ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া ইস্তফা দিয়ে উনি এখন ব্যাংককে থাকেন। গত ৬ মাস যাবৎ তিনি ব্যাংককে। আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করছেন ব্যাংককে থেকে। কাঞ্চন ভাই থাই এয়ার লাইন্সের বন্ধ হওয়া কাউন্টার ঝাড়ি মেরে খুলে ফেললেন। বোর্ডিং পাস্ নিলেন। সিকিউরিটির লোকজন কোথা থেকে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে এসে আমার ক্যাসেট গুলো থেকে ২/৩টি ক্যাসেট টেস্ট করে দেখলেন। নাহ, নির্ভেজাল গানেরই ক্যাসেট। সিকিউরিটি অফিসার আমার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ব্যাগ দিয়ে দিলেন।
দ্বিতীয় ধাক্কা খেলাম ইমিগ্রেশন ক্রস করার সময়। কাস্টমও অবাক, এত ক্যাসেট নিয়ে কি করবেন ? কাঞ্চন ভাই কাস্টম অফিসারকে বললেন, ভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অনেক ”খোর” আছে। আমার এই ছোট ভাইডি ”গানখোর”। কাস্টম অফিসার হাসতে হাসতে ব্যাগের চেইন বন্ধ করে দিয়ে বললেন, আমিও ”গানখোর” তবে একজনের গান শুনি শুধু। আমি বললাম কার গান ? উনি বললেন, শাহনাজ রহমতুল্লাহ’র। আমি একরাশ বিস্ময় নিয়ে ডিপার্চার লাউঞ্জে ঢুকে পড়লাম। এর পর থাই এয়ারলাইনসের সুপার জাম্বোজেট বোয়িং ৭৪৭ এ। দোতালা এয়ারক্রাফট।
ফ্লাইট TG-৩২২ রানওয়েতে ছুটছে। হালকা ঝাকি দিয়ে আকাশে ডানা মেলে উড়াল দিলাম। গুড বাই বাংলাদেশ।
আমি বাস্তবে ফিরে ৭০টি ক্যাসেটের মধ্য থেকে মাত্র তিনটি ক্যাসেট সিলেকশন দিলাম। মান্নাদে, শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও ঢাবিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র আপা শাহীন সামাদের ক্যাসেট। ভোর চারটায় এয়ারপোর্টে পৌঁছুতে হবে। আমরা কেউ ঘুমালাম না। শিয়া ব্যান খায়েকের এই ফ্ল্যাটের কাছেই মসজিদ। ফ্ল্যাটের পিছনে গোরস্থান। এই এলাকাটি মূলত মুসলিম এলাকা। অধিকাংশ মুসলমান এসেছে ভারত থেকে। একটু পরে মসজিদে আজান দিল। আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম। ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম।
৩রা ডিসেম্বর ৯১ এ ডেল্টা এয়ারলাইন্স ধরার জন্যে ভোরবেলা আমি ডনমুয়াং আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট-১ এ আসলাম। আমাকে বিদায় দিতে এসেছে কাঞ্চন ভাই, সাঈদ সোহরাব ও অশোক।
বোর্ডিং পাস্ হাতে নিয়ে শেষ বিদায় জানাব ওদেরকে। এরই মাঝে কাঞ্চন ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সব ক্যাসেটগুলো কি আবার সব নিয়েছ? আমি বললাম সব নেইনি। মাত্র তিনটি নিয়েছি, বাকি গুলো বাসায় রেখে এসেছি। আপনারা শুনবেন। সাঈদ অবাক হয়ে বলল, মাত্র তিনটি ক্যাসেট? আমি বিদায় নিয়ে ডিপার্চার লাউঞ্জের দিকে এগুতে এগুতে সাঈদ, অশোককে বললাম, ভালো থাকিস ।
কাঞ্চন ভাই, সাঈদ সোহরাব ও অশোক তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি বুঝতে পারলেও ঘুণাক্ষরে পিছে ফিরে তাকাইনি। এই ফিরে তাকানো বড় কষ্টের, বড় বেদনার। কিছু কিছু দৃশ্য অবলোকন করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাদেরকে দেয়নি। কিছু কিছু দৃশ্য এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে কঠোর মনোভাব আল্লাহ আমাদের অন্তরে সৃষ্টি করে রেখেছেন। ডিপার্চার লাউঞ্জের সিকিউরিটি চেকিং ক্রস করে আমি বোর্ডিং ব্রিজের দিকে চলে যাচ্ছি। আমার পৃষ্ঠ দেশের তৃতীয় নয়ন দেখছে, আমার অপসৃয়মান চলার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা তিনজন।
ছবিঃ ১. ডনমুয়াং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ব্যাংকক। ২.ইসতিয়াক আহমেদ দুলাল ও তাঁর স্ত্রী নীলম কুমারী শ্রীকুমার। ৩.TDK ক্যাসেট ৪. ব্যাংককের শিয়া বান কয়েক এলাকা।
লেখকঃ লুৎফর রহমান। লেখক, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ।
বিপুল/১৫ই এপ্রিল, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ | বিকাল ৪:৫৬