ডেস্ক নিউজ : তিনি ছিলেন আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির সেরা। যার আগমনের অপেক্ষায় ছিল আসমান জমিনের প্রতিটি জীব, প্রতিটি প্রাণী। যুগের পর যুগ ধর্মীয় পণ্ডিতরা তার আগমনের সুসংবাদ দিতেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার দেখা পাওয়ার অপেক্ষায় থাকতেন। তার সেই আগমন কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না।
তার নবুয়তের পরে যেমন বিশ্বব্যাপী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিল। তেমনই তার জন্মের সময়েও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ঘটেছিল অলৌকিক কিছু ঘটনাবলি। আজকের আয়োজনে আমরা সেরকমই কিছু ঘটনা জানব।
জন্মের আগে আবরাহার পতন, জন্মের পরে দুর্ভিক্ষ মোচন
হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে সোমবার সুবহে সাদিকের সময় এই পৃথিবীতে আগমন করেন। সে বছর নবীজির শুভাগমনের ৫০ অথবা ৫৫ দিন আগে আসহাবে ফিল বা হাতির ঘটনা সংঘটিত হয়। বিশেষ একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইয়েমেনের শাসক আবরাহা পবিত্র কাবাঘর ধ্বংসের জন্য মক্কা আক্রমণ করে। এতে বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে আসা হয়। তাই একে হস্তিবাহিনীর ঘটনা বলা হয়। তবে আল্লাহ তাআলার নির্দেশে একদল ছোট পাখির পাথর নিক্ষেপের ফলে পুরো হস্তিবাহিনী নাস্তানাবুদ হয়ে যায়। একে ঐতিহাসিকেরা মহানবী (সা.)–এর শুভ জন্মের পূর্বাভাসে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। (আস-সিরাতুল হালাবিয়া ১/৭৮)
নবীজির জন্মের আগে বেশ কয়েক বছর আরবে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। তাঁর জন্মের বছর আরবের সেই দুর্ভিক্ষ কেটে যায়। আরবের ঘরে ঘরে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে থাকে। যেহেতু একই বছরে কুরাইশরা আবরাহার বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল এবং দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল, তাই বছরটিকে আরববাসীরা ‘সানাতুল ফাতহ ওয়াল ইবতিহাজ’ বা ‘বিজয় ও আনন্দের বছর’ নাম দিয়েছিল। (আস-সিরাতুল হালাবিয়া: ১ / ৭৮)
নবীজির জন্মে এ ধরা হয়ে উঠেছিল নুরে নুরান্বিতহজরত উসমান ইবনে আবুল আস (রা.)-এর মা হজরত ফাতেমা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের মুহূর্তে আমি মা আমিনার কাছে ছিলাম। আমি দেখলাম, বিবি আমিনার ঘরটি আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। আকাশের সব তারকা নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল। আমার মনে হতে লাগল, তারকাগুলো যেন আমার ওপর এসে পড়বে। (ফাতহুল বারি ৬/৭২৬) তারকারাজির নিম্নমুখী হয়ে ঝুঁকে পড়ার দ্বারা এই ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে, অচিরেই পৃথিবী থেকে কুফর ও শিরকের অমানিশা দূর হবে। হেদায়েতের উজ্জ্বল আলোকে এ পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠবে।
পবিত্র কোরআনে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আলোচনা করেছেন। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় তোমাদের কাছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এসেছে (হেদায়েত) আলো ও সুস্পষ্ট কিতাব। যারা তার সন্তুষ্টি কামনা করে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এই হেদায়েতের আলোকবর্তিকা ও কিতাবের সাহায্যে শান্তির পথে পরিচালনা করেন এবং তারই অনুমতিক্রমে কুফর, শিরকের অন্ধকার থেকে তাদেরকে হেদায়েতের পথে নিয়ে আসেন। (সুরা মায়েদা ১৫-১৬)
আরেক বর্ণনায় এসেছে, জন্মের সময় বিশ্ব নবীর মায়ের পেট থেকে এমন একটি নুরের বিচ্ছুরণ ঘটেছিল, যার আলোকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত সবকিছু আলোকিত হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ভূমিতে আবির্ভূত হলেন তখন উভয় হাতের ওপর ভর দিয়ে ছিলেন। তারপর এক মুষ্টি মাটি নিয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়া)
নবীজির আগমনে বিশ্বের রাজপ্রাসাদগুলো হয়েছিল আলোকিত ও প্রকম্পিতমহানবীর জন্মক্ষণে একদিকে পৃথিবীর মূর্তিশালায় নবুয়তের সূর্যোদয়, অপরদিকে পারস্য সম্রাট কিসরার রাজপ্রাসাদে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। এই ভূমিকম্পের দরুন রাজপ্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। পারস্যের এক অগ্নিকুণ্ড, যা এক হাজার বছরব্যাপী বিরতিহীনভাবে জ্বলছিল তা সেই শুভ মুহূর্তে হঠাৎ নিভে যায়। সাওয়াহ নামক এক নদীতে যথারীতি পানি প্রবাহিত হচ্ছিল, নবীর আগমন মুহূর্তে হঠাৎ তার অথৈ জলরাশি শুকিয়ে যায় (সিরাতে মুস্তফা ১/৬৯)। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল অগ্নিপূজাসহ সব ভ্রান্তির অবসানের ইঙ্গিত।
রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের আমার প্রাথমিক বিষয় সম্পর্কে বলছি। আমি হলাম ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া ও ঈসা (আ.)-এর সুসংবাদ। আমার মায়ের স্বপ্ন, যা তিনি আমাকে প্রসব করার সময় দেখেছিলেন। সে সময় এমন এক নুর উদ্ভাসিত হয়েছে, যার মাধ্যমে আমার আম্মাজানের জন্য সিরিয়ার প্রাসাদও উজ্জ্বল হয়েছিল। (দালায়েলুন নবুওয়াত লিল-বায়হাকি ৩৫)
এক ইহুদির আশ্চর্য কাণ্ড
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, মক্কা শরিফে এক ইহুদি বাস করতেন। যে রাতে নবী (সা.) জন্মগ্রহণ করেন, সে রাতে তিনি বললেন, ‘হে কুরাইশ দল, আজ রাতে কি তোমাদের কোনো শিশু জন্মগ্রহণ করেছে?’ তারা বলল, ‘আমাদের জানা নেই।’ তখন তিনি বললেন, ‘দেখো, আজ এই উম্মতের নবী তাশরিফ এনেছেন। যাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে নবুওয়াতের চিহ্ন রয়েছে। তিনি দুই রাত পর্যন্ত দুধ পান করবেন না।’লোকজন দ্রুত ওই সভা থেকে উঠে অনুসন্ধান শুরু করল। জানা গেল যে, আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের ঘরে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে।
ওই ইহুদি বললেন, ‘তোমরা আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাও।’ ইহুদি তাঁর (নবজাতক) দুই বাহুর মাঝখানের মোহরে নবুওয়াতের চিহ্ন দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। জ্ঞান ফেরার পর তিনি বললেন, ‘নবুওয়াত বনি ইসরাইল থেকে চলে গেছে। হে কুরাইশ সম্প্রদায়, শোনো, এই নবীর অছিলায় তোমাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে তাঁর শুভাগমনের সংবাদ পৃথিবীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ছড়িয়ে পড়েছে।’ (মুস্তাদরাকে হাকিম ৪১৭৭)
কিউটিভি/আয়শা/০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪,/রাত ১০:২৫