
সিলভিয়া ও বেগমপাড়া
—————————-
হোয়াটস্যাপে রামানকে কল দিয়েছে সিলভিয়া। বাংলাদেশে আসার আগে তার ভূমিকা নিয়ে স্ববিস্তারে বর্ণনা দিচ্ছে সে। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো থেকে শুরু করে বাংলাদেশ হাই কমিশনে ভিসার জন্যে পাসপোর্ট জমা দেয়া সহ যাবতীয় প্রস্তুতির কথা এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছে সিলভিয়া। মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতার মত বাংলাদেশ প্রান্ত থেকে শুনে যাচ্ছে রামান।
সিলভিয়ার সব কথা শুনে রামান একটা প্রস্তাব রাখল সিলভিয়ার কাছে। তুমি বাংলাদেশে আসার আগে একটু হোম ওয়ার্ক কর প্লিজ। সিলভিয়া আগ্রহ ভরে জানতে চাইল, কি সেই হোমওয়ার্ক ? রামান সিলভিয়াকে বলল, তুমি বেগম পাড়ার কথা শুনেছ ? কানাডায় বাংলাদেশী ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা কানাডার বিভিন্ন জায়গায় অর্থপাচার করে তাদের স্ত্রী সন্তানদের রেখে দিয়েছে বেগম পাড়াতে । তারা ওখানে আছে বহাল তবিয়তে। এদিকে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাদের বৌ সন্তান কানাডায় রেখে বাংলাদেশে সমানে লুটপাট, অর্থপাচার করে চলেছে। তুমি ইচ্ছে করলে তোমার কাছাকাছি টরোন্টোতে খোঁজ নাও। পেয়ে যাবে বেগম পাড়ার ঠিকানা।
সব শুনে সিলভিয়া বিস্ময় প্রকাশ করল। কি বলো এসব ? বিদেশে স্ত্রী সন্তান রেখে দেশে একাকি জীবনযাপনের অর্থ কি ? তারা কিভাবে টাকা পাচার করে ? সরকার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনা ? রামান সিলভিয়ার কৌতহল দমনে কানাডার বেগম পাড়া সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরল।
বেগম পাড়া হচ্ছে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্থপাচারকারী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, সরকারী কর্মকর্তা ও ধনাঢ্য ব্যাবসায়ীদের দ্বিতীয় আবাসস্থলের (সেকেন্ড হোম) একটি প্রতীকী নাম। তথাকথিত বেগম পাড়া কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত। আদতে কানাডায় এই নামে কোনও স্থানের অস্তিত্ব নেই। শাব্দিক অর্থে বেগম পাড়া শব্দটি দ্বারা একটি স্থানের নাম বোঝালেও এটি বহুল সমালোচিত মানি লন্ডারিং কেলেঙ্কারি ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বেগম পাড়ার সাথে অর্থ পাচারকারীদের সংযোগ খুঁজে পেয়েছে। বেগম পাড়ায়, বাংলাদেশী ধন্যাঢ্য ব্যক্তিদের স্ত্রীরা স্বামীদের দ্বারা প্রেরিত অবৈধ অর্থ দিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। কাজ থেকে অবসর নিয়ে যেখানে লোকেরা কানাডায় তাদের বেগমদের কাছে যায়।
বেগম পাড়া একটি বাংলা শব্দ, যা উর্দূ বেগম পুরা শব্দ হতে এসেছে। তবে উর্দু বেগম পুরা একটি এলাকা বা আবাসস্থল নির্দেশ করলেও সেটা থেকে পরিবর্তিত বেগম পাড়া শব্দটি বাংলাদেশীদের কাছে ভিন্ন অর্থ বহন করে। ২০০৬ সাল হতে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় বিপুল হারে অভিবাসন শুরু হয়। বেগম পাড়া যা বৃহত্তর টরোন্টো এলাকায় সহধর্মিণীর কলোনী বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। আসলে হংকং চাইনিজরা শতাব্দী ধরে সেই বেগমপুরায় বসবাস করেন। বাংলাদেশের লোক এক সময় হাতেগোনা ছিল। রয়েছে পাকিস্তানি, ভারতীয় ও তুরস্কসহ আরব দেশের বেগমরা। সেখানে ওই সমস্ত দেশের ধনী পরিবারের বেগমরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন ও বাচ্চাদের ভালো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। আর তাদের স্বামীরা নিজের দেশে বা অন্য কোথাও ব্যবসা করেন বা বড় বড় চাকরি করেন। টরেন্টো আসা যাওয়া করেন মাঝে মাঝে।
অন্যদিকে যারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে উপার্জনকৃত অর্থ বেআইনি ভাবে পাচার করে টরোন্টোর বিশেষ কিছু অভিজাত এলাকা সহ কানাডার অন্যন্য অঞ্চলেও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ গড়ে নিজেদের স্ত্রী-সন্তানদের সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাদের সেই স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পদই বাংলাদেশীদের নিকট বেগম পাড়া নামে পরিচিত। সে হিসেবে কানাডায় বহু সংখ্যক বেগম পাড়া আছে, যে সংখ্যা শতাধিকও হতে পারে। তবে সাবেক বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম ব্রিটেনের দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার এক সাক্ষাতকারে বলেন যে কানাডার টরন্টোর একটি অঞ্চলকে স্থানীয় বাংলাদেশীরা ‘বেগম পাড়া’ হিসাবে উল্লেখ করেন।
রামানের ধারাবর্ণনায় সিলভিয়া চমকপ্রদ হয়ে পড়ল। সে বায়না ধরল, আমি আরও বিস্তারিত কিছু জানতে চাই। সিলভিয়ার আকুতি অনুভব করল রামান। সে কথা দিল সিলভিয়াকে, বেগমপাড়া সম্পর্কে আগামীতে তোমাকে আরও ধারণা দিব। তবে তোমাকে একটা এসাইনমেন্ট দিচ্ছি। তুমি সরেজমিনে বেগম পাড়া পর্যবেক্ষণ কর। এ বিষয়ে তুমি চাইলে জামান সর্দার তোমাকে হেল্প করবে। তুমিতো জান সে টরোন্টোতে আছে এখন। সিলভিয়া বলল, হ্যা আমি জান। ঠিক আছে আমার বাংলাদেশ যাওয়া কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি বেগমপাড়া স্টাডি করব। কি অদ্ভুত ব্যাপার রামান, আমি যাচ্ছি বাংলাদেশে অসহায় মানুষদের জন্যে বৃদ্ধাশ্রম গড়তে আর সেই বাংলাদেশীরাই সুদূর কানাডাতে গড়ে তুলেছে তাদের এক অভয়াশ্রম।
পর্ব- ৪
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে দুটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত।
বিপুল/০৮.১১.২০২৩/ রাত ৯.৫২