
ব্যাংকক জীবনের উপাখ্যানঃ ‘সনিকা’
——————————————
৯১ সালের শেষের দিকে আমরা যখন ব্যাংককে পা রাখলাম সনিকা তখন সম্ভবতঃ ৩ বছরের শিশু। ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে। পুতুলের মত দেখতে। জাস্ট একটা বেবিডল।
ফাওরাতে এটিএম মার্কেটে পুতুলের দোকানে একবার সনিকাকে পুতুলের মাঝে রেখে ছবি তুলেছিলাম। পরে সেই ছবি অনেককে দেখিয়েছি। পুতুল আর সনিকাকে আলাদা করার সুযোগ ছিল না। ফর্সা, ফুটফুটে, অনিন্দ্য সুন্দর সনিকা ছিল আমাদের ব্যাংকক জীবনে একটা নির্মল আনন্দের ঝর্ণা ধারা।
৩ বছর বয়সেই সনিকা পূর্ণাঙ্গভাবে দুটি ভাষায় কথা বলতে পারত। থাই ও হিন্দিতে। স্কুলে যাওয়ার সাথে সাথে ইংরেজী বলা শুরু করেছে। আর ২/১ টি বাংলা বাক্য বলতে পারত। এর মধ্যে একটি হলো ”লুফ্ফ ডুস্টু সেলে” মানে হল লুৎফর দুষ্ট ছেলে।
সকাল বেলা সনিকার বড় ভাই বান্টি স্কুলে যায়। দুপুর পর্যন্ত সনিকা থাকে সঙ্গিহীন। এই সময়টুকুতে সনিকাকে নিয়ে পুরো ফাওরাত দাঁপিয়ে বেড়াই। ৯০ দশকের গোড়ার দিকে ব্যাংককে আমাদের নির্বাসিত জীবনে সনিকা ছিল মরুভূমির ওয়েসিস ধারার মত।
একবার সনিকা তার বাবা মা ভাই সহ কয়েক দিনের জন্যে থাইল্যান্ডের বাইরে বেড়াতে যায়। ওদের বাসার একুরিয়ামে রাখা সনিকার প্রিয় মাছ গুলো এয়ার সাপ্লাই ইলেক্ট্রিসিটি কানেকশন যেন কি ভাবে ডিসপ্লেসড হয়ে মাছগুলো মারা যায়। ব্যাংককে ফিরে একুরিয়ামে মরা মাছ দেখে সনিকার সেকি কান্না ! পরের দিন ফাওরাতে আমাকে দেখেই সনিকা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ”আংকেল মেরা মছলি মর গিয়া”। তারপরে সনিকা আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি করল, সেটি অত্যন্ত্য ভয়াবহ। ”আমরা বাইরে ছিলাম, তুমিতো এখানে ছিলে, তোমার কারণে মাছ মারা গেছে”। ”লুফ্ফ ডুস্টু সেলে”।
ফাওরাতের দক্ষিণে চাওফিয়া নদী পার হয়ে সনিকা-বান্টিদের বাসা। সন্ধ্যা হলেই পুরো পরিবার টুকটুকে চড়ে ওরা ফাওরাত থেকে ঘরে ফিরে। চাওফিয়ার ব্রিজ অতিক্রম করার সময় বেপরোয়া মটর বাইকারদের সঙ্গে টুকটুকের সংঘর্ষে একদিন কম বেশি সকলেই আহত হয়। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় সনিকা। শিশু সনিকার কানি আঙ্গুল ব্রিজের কংক্রিটে ঘর্ষণ লেগে চামড়া ছিলে যায়। টুকটুকে বাজার সওদার মধ্যে ছিল কাছের বোতলে লিকুইড সল্ট। বোতল ভেঙ্গে লিকুইড সল্ট লেগে যায় সনিকার থেতলে যাওয়া আঙুলে। হাসপাতালে সনিকার কষ্ট দেখে অজান্তেই আমার চোখের পানি ঝরে।
পাদটীকাঃ আমাদের ব্যাংকক জীবনের অভিভাবক, শুভাকাংখী ছিলেন ইসতিয়াক আহমেদ দুলাল ( ক্রিট সিয়ামফাইরিন দুলাল) ভাই ও তাঁর স্ত্রী নীলম সিয়ামফাইরিন ভাবী। তাঁদের একমাত্র ছেলে বান্টি সিয়ামফাইরিন আর সনিকা সিয়ামফাইরিন।
বিগত ২৮ বছরে ব্যাংককে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। কিন্তু সকলের সঙ্গে দেখা হলেও দেখা হয়নি সনিকার সংগে। সনিকা বিরাট একটা সময় পার করেছে দিল্লীতে পড়াশোনা করে।
আজ ফেসবুকে দেখলাম সনিকার বিয়ে হয়ে গেছে গত ১৮ই মে ২০২২ খ্রিস্টাব্দে। কনফার্ম হলাম দুলাল ভাইর সংগে মেসেঞ্জারে। সনিকার বিয়ের ছবি দেখে একটা দৃশ্যের অবতারণা হল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ”কাবুলিওয়ালা” গল্পে পরদেশী মিনিকে শিশু অবস্থায় রেখে কাবুলিওয়ালা জেলে যায় খুনের দায়ে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কাবুলিওয়ালা ছুটে যায় মিনির কাছে। বয়সের পরিক্রমায় মিনি তখন যুবতী, সেদিন তার বিয়ে হচ্ছে। কাবুলিওয়ালা দূর থেকে মিনির সঙ্গে দেখা না করে চোখের পানি ফেলে বিয়ের আশীর্বাদ করে বিদায় নেয়। সনিকা ব্যাংককে, আমি ঢাকায়। সনিকার বিয়েতে প্রাণভরা দোয়া ও আশীর্বাদ থাকল। ওর নতুন জীবন মঙ্গলময় হোক। আমার বিশ্বাস, আমার ফেসবুক বন্ধুরা যারা এই পোস্টটি পড়বে, তারা সকলই সনিকার জন্যে, সনিকার জীবন সঙ্গীর জন্যে, তাদের নতুন জীবনের জন্যে শুভকামনা প্রকাশ করবে।
লেখকঃ লুৎফর রহমান, রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট।
বিপুল/ ২১.০৫.২০২২ খ্রিস্টাব্দ/ রাত ১০.৩০