
কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার তবকপুর ইউনিয়ন থেকে মারুফা রুমী ফোন করে উচ্ছাসময় কণ্ঠে চিৎকার করে বলছে, আংকেল আপা ফিরে এসেছে। লিপি আপা ফিরে এসেছে। আপা এখন বাড়ীতে। আংকেল, আল্লাহ আপনার ভালো করবে, কুড়িগ্রামের ডিসি স্যার, সচিব স্যার, উপদেষ্টা স্যারকেও খবরটা দিবেন।
লিপি আপা এখন বাড়ীতে আছে ? কথা বলবেন আপার সংগে আংকেল ? আমি বললাম দাও। অপর প্রান্তে লিপি ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে শুধু। আমি হাসতে হাসতে লিপির সাথে কথা বলতে যেয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। আমিও আনন্দ বেদনার এক দোলাচলে নোনা জলে ভিজিয়েছি আমার দু’চোখ। ফ্ল্যাশব্যাক– ১৯ মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ কুড়িগ্রাম জেলার ডিসি জনাব নুসরাত সুলতানা আমার হোয়াটস্যাপে একজনের কিছু টেক্সট ফরোয়ার্ড করে দিয়েছেন। আমি টেক্সট গুলো পড়লাম। টেক্সটগুলো হুবহু এরকম – ”Sir, আমার বোন প্রায় ৪-৫ মাস হয়, সৌদি আরব দেশে গেছেন। Sir, এখন আমার বোনের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। Sir, আমার বোন এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জার লড়তেছে,,Sir, আপনি আমার বোনকে বাঁচান।
Sir, সৌদি আরবে রিয়াদে আছে। Sir, মালিকের নাম আহমেদ। পেশা- পুলিশ Sir, মালিকের মোবাইল নাম্বার 00966—- Sir, আমার বোন ১ সপ্তাহের বেশি অসুস্থ তার কোন চিকিৎসা করা হয় না, বরং নির্যাতন করা হচ্ছে। Sir, আপনার কাছে আমার Request আমার বোনের জন্য কিছু একটা করুন। Sir, অন্তত আমার বোনকে জীবিত বাড়িতে ফিরার ব্যবস্থা করুন”। ডিসি মহোদয়ের কাছে পাঠিয়েছে লিপির ছোটবোন কলেজ ছাত্রী রুমী। বোনকে ফেরত পাবার ব্যকুলতায় রুমি কতবার যে ডিসিকে স্যার বলে আকুতি জানিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কুড়িগ্রাম জেলার ডিসি খুবই চৌকষ ও মেধাবী একজন মানুষ ।
যখন তিনি দেখলেন আমি টেক্সট সিন করেছি তখনই কল দিয়ে বললেন, ভাইয়া প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা স্যার এবং সিনিয়র সচিব ডঃ নেয়ামত স্যারের আপনি যেহেতু খুব কাছের মানুষ, আমি মিনিস্ট্রিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে লিখেছি, সংশ্লিষ্ঠ সকলের সংগে কন্ট্যাক্ট করেছি, আপনি ভাই ফলোআপ করে মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে একটু চেষ্টা করুন। আমি ডিসি মহোদয়কে কথা দিলাম – আমি সর্বাত্বক চেষ্টা করব। বাদবাকি আল্লাহ ভরসা। আমি দুই মন্ত্রণালয়, আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় বড়ভাই ড.আসিফ নজরুল মহোদয়ের হোয়াটস্যাপে ডিসি কর্তৃক প্রেরীত লিপির সকল ডকুমেন্টস পাঠিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলাম বিষয়টির দ্রুত সমাধান করার জন্যে।
ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষমতাকালীন পুরো ১৫ বছর যাবৎ যিনি প্রাজ্ঞ একজন এডমিন ক্যাডার হিসাবে নির্যাতিত ছিলেন। গ্রেফতার, জেল জুলুম পর্যন্ত সহ্য করেছেন, আগস্ট ‘২৪ পটপরিবর্তনের পর সিনিয়র সচিব হিসাবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পদায়নকৃত ড.নেয়ামতউল্লাহ ভূঁইয়া মহোদয়ের হোয়াটস্যাপেও বিষয়টি সদয় অবহিত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে অনুরোধ জানালাম। এরপরে চলল,বাউরা তবকপুরের কলেজ ছাত্রী রুমির মাধ্যমে ডিটেইলস ফলোআপ। রিক্রুটিং এজেন্সির নাম ,লোকজনকে খুঁজে বের করার এক চ্যালেঞ্জিং প্রচেষ্টা। হুমকী ধামকিও দিতে হলো রিক্রুটিং এজেন্সিকে।
আর চলল, সরকারি পর্যায়ে লিপিকে উদ্ধার কার্যক্রম। কিছুদিন পরে নিষ্ঠুর,নরপিশাচ সৌদি পুলিশ আহমদ এর বাড়ী থেকে উদ্ধার করে সৌদি আরেকজনের বাসায় কাজ ও থাকার ব্যবস্থা হয় লিপির। কিন্তু রুমী ও রুমীর মায়ের কথা হলো, ফিরিয়ে এনে দেন লিপিকে। আবার শুরু হলো ফলোআপ। মিনিস্ট্রি থেকে চাপ পড়ল রিক্রুটিং এজেন্সির উপরে। আমি চাপ দিলাম ভিন্ন স্টাইলে। যৌথ উদ্যোগের ফলোআপের কারণে সাহের বানু লিপি তার জন্মস্থান কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার বাউরা তবকপুরে পৌঁছে গেল গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে বছরের ২২৭তম দিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে। রিটার্ন অফ হোম, লিপির ফিরে আসায় প্রবল খুশি আর আনন্দানুভূতি সৃষ্টি হয় আমার হিয়ারও মাঝারে। আমি কাউকেই চিনতাম না, এখন পর্যন্ত এদেরকে দেখিওনি কোনদিন ।
আমার সাথে কথা বলেছে লিপির ছোটবোন রুমি, তাদের মা, আর ভাই। ওরা যখন কথা বলতো, পাশে লিপির শিশু কন্যা ওদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। আজ সে শিশুকন্যা তার মা এর কোলে। লিপির ফিরে আসা অথবা বেঁচে ফিরে আসা আল্লাহর অশেষ রহমত। উপলক্ষ কুড়িগ্রামের ডিসি জনাব নুসরাত সুলতানা। তিনি তাঁর দাপ্তরিক দায়িত্বের বাইরে মানবিক বিবেচনায় আমার সংগে বিষয়টি শেয়ার করেছেন। এটি তিনি নাও করতে পারতেন। মাননীয় উপদেষ্টা, সিনিয়র সচিবের কাছে কৃতজ্ঞ ,তাঁরা আমলে নিয়েছিলেন এই মানবিক বিষয়টি। পরম করুনাময় আল্লাহর কাছে শোকরিয়া, আমার কুড়িগ্রামের হতভাগী মেয়ে সাহের বানু লিপি জীবন নিয়ে ফিরে এসেছে তার আপন আঁধারে।
পাদটীকাঃ রুমির উচ্ছাসময় ফোন পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম আজ রাত ৯.১৫ মিনিটে ”আজ আমি বেজায় খুশি-মহা খুশি। এই খুশি, এই আনন্দের কথা জানাবো আজ রাতে। আমার ফেসবুক টাইমলাইনে–”। এরপরে শুরু হলো কুড়িগ্রাম সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে কৌতুহলী ফোন কল। সকলই জানতে চায়, ভাই কি ঘটনা ? কি খুশির খবর ? আমি যাই বঙ্গে, আমার কপাল যায় সঙ্গে। এই ফোন কল গুলোর কারণ আমি জানি। আরেকটি সুখবর সৃষ্টি করতে লিপি,রুমির মা, তবকপুরের কোহিনুর বেগম ফোন করে আমাকে বলল, ভাইজান বড়বেটিকতো ফেরত আইনলেন, এখন ছোট বেটি রুমির একটা চাকরানদার জামাই দেখি বিয়া দিয়া দ্যান।
আমি রুমির মাকে হো হো করে হেসে বললাম, চাকুরীজীবি জামাই কোথায় পাব ? রুমির মা বলে, ক্যা পাবার নন? তোমরা মন্ত্রীর ঘরক ধরি চাকরানদার জামাই জোগাড় করি দিবেন ? আমি ফোন কল থেকে বিদায় নিয়ে মনে মনে হাসি –এবার কি ঘটকালি করতে হবে?
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক।তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে চারটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন, যা দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত পাঠক মহলে। গঠনমূলক ও ইতিবাচক লেখনীতে তিনি এক নতুন মাত্রা সংযোজন করতে সক্ষম হয়েছেন।
কিউটিভি/আয়েশা/১৭.০৮.২০২৫/রাত ৮:১৮