
শহিদ আহমেদ খান সাবের,সিলেট প্রতিনিধি : হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম হানাদার মুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগ আর তিতিক্ষা এবং কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও গৌরবগাঁথা গণবীরত্বে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় বাঙালি জাতি।১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের হত্যা যজ্ঞে মেতে উঠলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। সর্বস্তরের বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের পাশে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে এগিয়ে আসে প্রতিবেশী দেশ ভারত। সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং কোটি বাঙালিকে আশ্রয় দিয়ে ভারত সাহায্যের হাত বাড়িযে দেয়। ওই সময় পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন দিয়ে সরাসরি পক্ষ্য নেয়।মরহুম আব্দুল আজিজ খান একজন পরোপকারী, সহজ-সরল ও সাহসী প্রাণপুরুষ। তিনি ইসলামী রাজনৈতিক দলের একজন নেতা ছিলেন। তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য, হিংসা-বিদ্বেষ লেশমাত্র ছিল না। তিনি এলাকার ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। ১৯৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠেনি। তিনি ছিলেন একজন মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী।১৯৭১ সালে দেশের কঠিন পরিবেশে যখন অধিকাংশ মানুষ নিজেদের জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনি মরহুম আব্দুল আজিজ খান শুধু মুসলমান নয়, অমুসলিমদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন নিজ পরিবারের চাইতে গ্রামের প্রতিবেশী, এলাকার জনপদ বিশেষ করে কুচাই ইউনিয়নের প্রতিটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের চোখে দেখেছেন। যার ফলে ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী অগ্নিঝরা ময়দানে হিন্দুদের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়ার কারণে তাকে পশ্চিমাদের ক্যাম্পে নিয়ে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যা দক্ষিণ সুরমার ইতিহাসে উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে থাকবে আগামী প্রজন্মের কাছে। তিনি সেদিন নিজ বাড়ি, খানবাড়িতে হিন্দু মহিলা, বৃদ্ধ পুরুষ ও মাছুম বাচ্চা-কাচ্চাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাইতো মরহুম আব্দুল আজিজ খান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় কুচাই ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে একজন সফল ও সাহসী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নের এক নির্ভিক ব্যক্তিত্ব, এলাকার প্রবীণ মুরব্বী ও সমাজ সেবক আব্দুল আজিজ খান। তিনি ছিলেন সাহিত্য প্রেমিক, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন পন্ডিত, লৌকিকতা ও আত্মপ্রচার বিমুখ, মানব দরদী ও মহান কর্মবীর। তিনি পরিচ্ছন্ন জীবনের অধিকারী ছিলেন বলেই তাঁর কাজে-কর্মে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ছিলো। এলাকার শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ সেবার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান রেখেছেন খান সাহেব।সমাজসেবা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সেদিন তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের সম্পদ ত্যাগ স্বীকারের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ সালে গোটাটিকর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি তাঁর শ্রম, মেধা ও চিন্তার দ্বারা আজ প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সকলের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। উক্ত মাদরাসা থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়া করে দেশে ও বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত রয়েছে। তার মধ্যে শুধু অপরের কল্যাণের চিন্তা দেখেছি; হিংসা-বিদ্বেষ, সমাজে শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে এমন কোন কর্ম তার কাছ থেকে কখনও প্রকাশ হয়নি। তিনি আকাশের উদারতা নিয়েই তার জীবন পরিচালিত করেছেন। আর তাইতো তিনি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল মানুষের চোখে অত্যন্ত মহৎ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি উর্দু ও ফার্সী ভাষা জানতেন।
সুশিক্ষিত ব্যক্তি ও সংগঠক ছিলেন।ধর্মপ্রাণ, নামাযী, আল্লাহওয়ালা এ ব্যক্তিটি সারাজীবন অত্যন্ত সরল ভাবে জীবন অতিবাহিত করেছেন। নিজ জীবনে জাগতিক প্রতিষ্ঠার কোন কর্মসূচী নেননি কখনও, শুধু সমাজের কল্যাণে কাজ করতে ভালবাসতেন। এ ধরনের উদার, মহৎ ব্যক্তি বর্তমানে দুই/চারজন মিলে এ সমাজে। যিনি কখনও সমাজের মানুষের নিরাপত্তা বিঘিœত হয়, এমন কোন কথা ও কাজ করেননি। তিনি তার এলাকার মর্যাদা ও বাড়ির ঐতিহ্যকে ক্ষুন্ন হতে দেননি কখনও।তাইতো তিনি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের অন্তরে স্থান করে নিয়েছিলেন। তার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য মরহুম আব্দুল আজিজ খান ফাউন্ডেশন তাঁর সুযোগ্য সন্তান-সন্ততি ও আত্মীয়-স্বজনরা করেছেন।
খান সাহেব পড়াশুনায়, কর্মের নিপুনতায়, মিষ্টি কথা ও নরম কোমল ব্যবহারে বাড়ী ও এলাকার সকলের মধ্যে অতুলনীয়। কেউ কোন বিষয়ে তার সাথে তর্ক করলে তিনি সামান্যও বিরক্ত না হয়ে ধৈর্যের সাথে অতি নরম ভাষায় যুক্তিপূর্ণভাবে বুঝিয়ে দিতেন। এলাকায় সামাজ কল্যাণমূলক কাজে তিনি নিজের সামর্থ্য না থাকলেও ধার করে হলেও সাহায্য করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়তেন।আমি নিজেও বার্ধক্যে, আমার বয়স যখন ১৭ তখন থেকেই খান সাহেবের সাথে পরিচয়। তাঁর মতো এমন ভদ্র, নম্র, উদার মিষ্টভাষী, অমায়িক, সদ্য হাস্যমুখ, স্নেহশীল, মার্জিত রুচির মানুষ জীবনে আমি খুব কমই দেখেছি। বহু বিচিত্র গুণের সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর মাঝে। অথচ তিনি ছিলেন অহংকার বিবর্জিত, বিনয়ী এক মাটির মানুষ।
অনেক দিনের আমার ইচ্ছাটা পুরাপুরি পুরন না হলেও আজকের এই লেখার মাধ্যমে কিছুটা মনের আবেগ প্রকাশ করতে পেরে নিজকে কিছুটা হলেও দায়মুক্ত মনে হচ্ছে। বিশ্বাস করি, এমন ব্যক্তির জীবন-চরিত্র পাঠে এলাকা ও সমাজ উপকৃত হবে। অন্যরাও উৎসাহ পাবে। আমার কর্ম জীবন এ পর্যায়ে পৌঁছার পিছনে যাদের প্রেরণা, আন্তরিক আশীর্বাদ ও সহযোগিতা রয়েছে তাদের মধ্যে খান সাহেব ছিলেন অন্যতম। তিনি কোন কোন বিষয় আমার থেকে স্বতন্ত্র ছিলেন।
১৯৫৮ সালে ডা: আব্দুল মালেকের ষ্টেশন রোডস্থ সিলেট হোমিও হাউজে আমি চাকুরী করতাম। তখন আমার বয়স ১৭। সেই সময় আব্দুল আজিজ খান সাব প্রায় যেতেন ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে। ডাক্তার সাব তখনও জামায়েত ইসলামী করতেন না। আমার মনে আছে তিনি বিভিন্ন সময় ইসলামিক বই দিতেন ডাক্তার সাবকে। এরমধ্যে একটি বুকের নাম ছিল ইসলাম ও কমিউনিজম। মাওলানা মওদুদী সাহেবের লেখা। আব্দুল আজিজ খান সাব আমাকে খুব ভালোবাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন বলেই তিনি আমার কাছে বই দিতেন এবং আমি ডা. সাহেবের কাছে দিতাম। আবার যখন তিনি সংগ্রহ করতেন, আমাকে তাগিদ দিতেন। পরবর্তীতে আমার কাছ থেকে তিনি তাহার বই ফিরত নিতেন। এইভাবে ডাক্তার সাব জামায়েতে ইসলামের দাওয়াত পান। আমি তখন শহরের কুমারপাড়ায় ভাড়াটিয়া বাসায় থাকতাম। বাসা ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। একদিন খান সাব আমাকে পরামর্শ দিলেন উনার গ্রামে বসবাস করার জন্য।
আমি তারই পরামর্শক্রমে পাঠানপাড়া গ্রামে চলে আসি। তখন বাসা ভাড়া ছিল ৬ টাকা। কিন্তু কুমারপাড়ায় বাসা ভাড়া দিতেন ডাক্তার সাব। যখন আমি এই এলাকায় আসি তখন এই এলাকায় কোন ডাক্তার ছিলেন না এবং ইনজেকশন দেওয়ারও কোন মানুষ ছিলেন না। সেই সময় আমার খুব প্রয়োজন ছিল। এই এলাকায় তখন আমাকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইনজেকশন পুশ করতে হত।কুচাই ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি থাকাকালীন সময়ে আব্দুল আজিজ খান সাবের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাঁর পরামর্শক্রমে আমি হোমিও কলেজে ভর্তি হই। তখন রাজা জিসি হাই স্কুল অস্থায়ীভাবে হোমিও কলেজ ছিল। প্রিন্সিপাল ছিলেন ডাঃ এ রসুল। আমি এই কলেজ থেকে লেখাপড়া করে ডাক্তার হই। ডাক্তার হওয়ার পর খান সাবের পরামর্শক্রমে আমি ‘জনতা হোমিও’ নামে ফার্মেসী ও চেম্বার তৈরী করি। আজ পর্যন্ত এই ফার্মেসী বিদ্যামান আছে। আমার এই ফার্মেসী বর্তমানে চাঁদনী ঘাটে অবস্থিত।
যখনই আমি খান সাবের কাছে কোন পরামর্শ চেয়েছি তখন উদারভাবে পরামর্শ দিতেন। মেম্বার থাকাকালীন সময়ে তিনি আমার এলাকা তথা পুরো ওয়ার্ড উন্নয়নের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। তিনি উক্ত এলাকার উন্নয়নের রূপকার হিসাবে আখ্যায়িত ছিলেন। আমাদের এলাকার রাস্তা-ঘাটের করুণ ও বেহাল অবস্থা ছিল। তখন ছোট ছোট রাস্তায় জলাবদ্ধতা লেগেই থাকতো। তিনি মেম্বার হওয়ার পর এলাকায় অনেক রাস্তা মেরামত করে জলাবদ্ধতা দূর করেন এবং চলাফেরার উন্নত ব্যবস্থা করেন। আজ এলাকার জনগণ সেই উন্নয়ন উপভোগ করতে সক্ষম হচ্ছেন।স্বাধীনতার সময়ে সপরিবারে আমি আজমিরিগঞ্জে ছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন আমি এলাকায় ফিরে আসি তখন দেবেন্দ্র নাথ ও তার ছেলে রাজেন্দ্র নাথ এবং বিভিন্ন হিন্দু ও মুসলমানের কাছ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের বিভিন্ন তথ্যবহুল ঘটনা জানতে পাই। ঘটনার বর্ণনা শুনে আমার শরীর শিউরে উঠে। দেবেন্দ্র নাথের সাত ছেলে ও দুই মেয়ে। আব্দুল আজিজ খান সাব তখন কিভাবে স্বাধীনতার সময়ে পাঠানপাড়া (আচার্য্য পাড়া, যৌগিশাসন) হিন্দুদের বসতিসহ তাদেরকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, তা বর্ণনা করেছে। তাদের মুখে আমি শোনেছি আচার্য্য পাড়া তথা নাথ পরিবারের উপর হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা।
রাজেন্দ্র নাথের বাবা দেবেন্দ্র নাথ স্বর্গীয়, তাঁর মা সুধাবেলি নাথও স্বর্গীয়। তবে তাঁর ছেলে অভিনাথ, ইরেন্দ্র নাথ, ময়না নাথ, খোকা নাথ, বাবুল চন্দ্র নাথ, লাখাই চন্দ্র নাথ, বীরেন্দ্র নাথ এবং মেয়ে ঝর্ণারানী নাথ ও রাধারাণী নাথ প্রমূখ এখনও কেউ কেউ বেঁচে আছেন। ইরেন্দ্র নাথের বয়স তখন অনুমানিক ১৭ বা ১৮ ছিলো। বর্তমানে তাঁর বয়স ৬৫ হবে। তাঁর বক্তব্য হলো, ৭১-এ এলাকার স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাঁর বাবা-মা তাদের ভাই-বোনকে নিয়ে তৎকালিন জনপ্রতিনিধি আব্দুল আজিজ খানের আশ্রয় নিলে তিনি তাদের সবার প্রাণ রক্ষা এবং মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষায় যে ভূমিকা রেখেছেন তা ভুলার মতো নয়। আজও নাকি মাঝেমধ্যে তারা এ স্মৃতি পারিবারিক ভাবে আলোচনা করে থাকে।
খান সাব সেই সময়ে মেয়েদের ইজ্জতের নিরাপত্তার জন্য নিজ বাড়িতে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া সহ যাবতীয় ব্যবস্থা করে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁর এ ভূমিকার কারণে ১৯৭১-এ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ওরা রক্ষা পায়। তখনকার সময়ে শুধু এই পরিবার নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা-ঝামেলা, পারিবারিক-আর্থিক সকল ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন খান সাব। হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে খান সাবকে কিছু কুচক্রি মহলের ইন্দনে পাক হানাদার বাহিনী তখনকার লালমাটি ক্যাম্পে নিয়ে বিভিন্নভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালায়। ঐ সময় তিনি সকলের প্রার্থনায় ও উপরওয়ালার আশীর্বাদে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পান।ইরেন্দ্র নাথ আরো জানায়, ৭১ এর স্বাধীনতার সময়ে তার বাবা-মা সহ সবাইকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় একটি কুচক্রি মহল। যার ফলে তারা বিভিন্ন আসবাবপত্র, টিন, এমনকি বাড়ি বেদখলের চক্রান্তের শিকার হয়। তখনকার খান সাবের হস্তক্ষেপে তারা বাড়ি ফেরতসহ সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে পরিবারের সদস্যরা প্রাণে রক্ষা পায়। আজ তাদের বাবা নেই, থাকলে আমি আরো কিছু তথ্য দিতে পারতাম।
আমি আজ আজিজ খান সাব সম্পর্কে সময়ের তাগিদে কিছু কথা পেশ করলাম নিজের বিবেকের দায় থেকে। হিন্দু পরিবারের জন্য তিনি একজন মুসলমান হয়েও যে ভূমিকা রেখেছেন তা আমাদের চোখের সামনে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এবং তা প্রমাণ করছে এই বাংলাদেশে সম্প্রদায়িকতা নেই।ইরেন্দ্র চন্দ্র নাথের ভাই বাবুল দেব নাথের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে আমি জানতে পারি, তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে হানাদার বাহিনী তার বাবাকে ধরে নিয়ে জুলুম অত্যাচারের মাধ্যমে আব্দুল আজিজ খান সাবের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোন তথ্য না পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয় পাক বাহিনী। খান সাব জেল থেকে বেরিয়ে পাঠানপাড়ার কালাম সাব এবং কদমতলীর মীর বক্স সাবের সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে তার বাবাকে রক্ষা করে ফিরিয়ে আনেন। পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত তাদের পরিবারের বিভিন্ন সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে আসছেন খান সাব। শুধু তাদের পরিবার নয়, পাঠানপাড়ার সকল পরিবারকে তিনি একচোখে দেখতেন। এলাকার উন্নয়নে রাস্তাঘাট সহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তিনি কাজ করে গেছেন।
পারিবারিক সমস্যাসহ যে কোন দুর্যোগে উনাকে ডাকলে তিনি সাড়া দিয়ে সমস্যার সমাধান করে দিতেন। আজ তিনি দুনিয়াতে নেই। তাই আমাদের এলাকার সমস্যা ও উন্নয়নের শূন্যতা অনুভূব করছি এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর জন্য আশির্বাদ করছি।আরেকজন মহিলা শান্তিরাণী নাথ, স্বামী-রাজন্দ্র নাথ (স্বর্গীয়) বলেন, ব্যক্তিগতভাবে ’৭১-এর স্বাধীনতার সময় তার স্বামী সহ তিনি বিভিন্ন সময়ে সমস্যা ও নিরাপত্তার জন্য খান সাবের কাছে গিয়েছেন। খান সাব তাদেরকে আশ্রয় দিতেন। শান্তিরাণী নাথ আরো বলেন, লালমাটি পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে ইজ্জত রক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে আব্দুল আজিজ খান সাব তার জীবনবাজি রেখে তাদেরকে জালালপুর ইউনিয়নের রাইখাল গ্রামের নিরাপদ স্থানে তাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আজিজ খান সাব সত্যি উদার ও সাদা মনের মানুষ ছিলেন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের আরেকজন বয়ো:বৃদ্ধ সুধন্য আচার্য্য, বয়স ৭৬, পিতা- জ্ঞান ঠাকুর (স্বর্গীয়) আবেগাপ্লূত হয়ে চোখে জল ফেলে বলেন, ৭১-এ স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাঁর মা’কে হত্যার পরিকল্পনা করলে খান সাব রক্ষা করেন। তিনি আরো বলেন, ৭১ এ আমার পরিবারকে নিয়ে প্রাণে বাঁচার জন্য অন্যত্র ছুটে যাই। তখন আমার বাবা-মা বাড়ীতে একা। স্বাধীন হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে মা’র কাছে যুদ্ধকালীন সময়ের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আব্দুল আজিজ খান সাবের ভূমিকার কথা টেনে তাদের নিরাপত্তা, খাওয়া-দাওয়া সহ বিভিন্ন কর্মকান্ড বর্ণনা করেন। শত্রুদের হাত থেকে আমার মাকে রক্ষার জন্য তিনি সকল ক্ষেত্রে কলাকৌশল অবলম্বন করেন। সৃষ্টিকর্তার আর্শিবাদে খান সাহেব আমার মাকে রক্ষা করে ছিলেন।আব্দুল আজিজ খান সাব সম্পর্কে আরো কতো স্মৃতি ঝুলে আছে মনে। এই মূহুর্তে এ ধরনের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির জীবন বৃত্তান্ত প্রকাশ করা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে আমি মনে করি। আমি মরহুম আব্দুল আজিজ খান এর আত্মার চিরশান্তি কামনা করছি।
কিউটিভি/অনিমা/০৭.১২.২০২২/রাত ১০.১৭






