
জলমানব-বন্ধু মরহুম খান এ মির্জা মাসুদ জুয়েল
———————————————————-
আবারো ফিরে যাই ১৯৯৪ সালের শেষের দিকে। আপনাদের কি মনে আছে ? কুমিল্লার জলমানব মিজানুর রহমান ও খুলনার জলমানব নওশের আলীর কথা? যারা বিরতিহীন ভাবে একটানা ৭২ ঘন্টা পানির নীচে ডুব দিয়ে থেকে রেকর্ড সৃস্টি করেছিলেন ! এসব নিউজ নিয়ে সে সময়ে সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল।
আমরা তখন জগন্নাথ হলে থাকি দুপুরে খাওয়ার পরে আমি,বন্ধু নির্মল দাস, মন্জুরুল আলম লিটু,ও জুয়েল হলের উত্তর ভবনের ২০/১ নং রুমে আড্ডা দিচ্ছি। আমাদের ছাত্রজীবনে ম্যাক্সিমাম সময়েই জুয়েলের সাথে নির্মলের একটা খুনসুটি লেগে থাকতো। সারাদিন তারা দুইজন একসাথে আড্ডা দিবে গান গাইবে চা খাবে আবার কথায় কথায় খুনসুটি লেগেই থাকতো। এ এক চরম মিথস্ক্রিয়া।
নির্মল জুয়েলের সাথে সব সময় জুয়েলের আন্চলিক ভাষায় কথা বলার চেস্টা করতো। সব মিলিয়ে সাতক্ষিরার আন্চলিক ভাষা আর নির্মলের বলার চেস্টায় উচ্চারনগত ত্রুটির কারনে নির্মলের ভাষাটা অন্য রকম শোনা যেতো। আমরা সবাই নির্মল আর জুয়েলের এই কথোপকোথন খুব উপভোগ করতাম। আমাদের বন্ধুত্বের গভীরতা বা এ অপূর্ব সম্পর্কের রসায়ন টা আসলে আলোচনা করে বোঝানো যাবে না।
কখনো আমাদের বন্ধু মহলের আড্ডা কেউ দেখলে সত্যিই চমৎকৃত হবেন। বিমোহিত হবেন। আমাদের আড্ডায় কখনো কেউ উপস্থিত হলে সত্যিই দেখে ঈর্ষান্বিত হবেন যে এখনো আমাদের মাঝে কি সুদৃঢ় বন্ধুত্বের বন্ধন ! আমৃত্যু আমাদের এই অকৃত্রিম মধুর বন্ধন চলমান থাকুক সে জন্য দোয়া করবেন সবাই।
২০/১ নং রুমে লাঞ্চ পরবর্তি আড্ডায় একদিন শুয়ে গল্প করছিলাম। নির্মল পেপার পড়ছিল। এ সময়ে সাতক্ষিরার একটি নিউজ দেখে নির্মল চিৎকার করে উঠল। নির্মলের চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী সাতক্ষিরার ভাষায় জুয়েলকে বললো “দেখেছিস জুয়েল তোদের এলাকাতি এক লোক নওশের ৭ ঘন্টা পানিতে ডুবি ছিলো”। জুয়েল শুনে বললো এটা কোনো বিষয়ই না,আমিও পারি। নির্মল মজা করে বললো তুমি মোক্তার খা’র পুত তুমি পাইরবে না ?
জুয়েল বললো শালো আমিও পানির নিচে কমপক্ষে ৩ঘন্টা ডুব দিয়ে থাইকতে পাইরবো। নির্মল বার বার জুয়েলকে প্রোভোক (provoke) করার চেস্টা করছে। বন্ধু তুমি পাইরবে না, জুয়েল বলে পাইরবো বাজি ধর। এতক্ষন আমি আর লিটু নিরব শ্রোতা ছিলাম। আমি জুয়েলকে বললাম কি চাও তুমি? বললো বাটা কোম্পানীতে একটা নতুন জুতা আছে দাম ৯৯৯.৯৯ টাকা ওটা কিনে দিতে হবে। আমি বললাম ডান, তুমি জুতা পাবে।
আমরা ৪জনই এক্সাইটেড। দেখি জুয়েল কি করে ? জুয়েল রেডি হচ্ছে তখন ৩.৩০বাজে ,জুয়েল শুধু বললো আমাকে একটা লাঠি একটা গামছা এবং দুইটা পিচ্চি দিতে হবে। যাদের কাজ হলো আমি ডুব দিলে ওরা আমাকে পানিতে ঠেসে ধরবে যাতে আমি ভেসে না উঠি। আমাদের কাজ করতো নাসির আর সমির দুইজনকে রেডি করলাম। জগন্নাথ হলের মাঠে তখন ক্রিকেট খেলা চলছিলো, যেই কথা সেই কাজ।
বিকাল ৪টায় জুয়েল সমির নাসির এবং তার লাঠি গামছা নিয়ে জগন্নাথ হলের পুকুরে নেমে পড়লো। জুয়েল সুরা পড়ে লাঠিটা ধরে ডুব দিল,সমির এবং নাসির তার ঘাড়ের উপর বসে রইলো যাতে ভেসে না উঠে,জুয়েল মাঝে মাঝে হাত তুলে আমাদেরকে ঈশারা দিচ্ছে যে সে সুস্থ এবং বহাল তবিয়তে পানির নীচে আছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের খবর দিলাম,সংবাদ কর্মীরাও এক্সাইটেড জুয়েলের মত এত পরিচিত একজন ছাত্রনেতার এ ধরনের কর্মশৈলী দেখার জন্য।
ইতোমধ্যে পানির নীচে জুয়েলের ৩০ মিনিট পার হয়েছে। সারা হলে খবর হয়ে গেলো জুয়েলভাই ৩০মিনিট যাবত পানির নীচে রয়েছে ,মাঠে ক্রিকেট খেলা বন্ধ করে সবাই পুকুরপাড়ে চলে আসছে। সব মিলিয়ে পুকুরের চারিদিকে ২০০/৩০০ লোক সমবেত হয়েছে। একটু পর পর জুয়েল পানির নীচ থেকে হাত তুলে বিভিন্ন স্ট্যাইলে আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। কখনো ভিক্টোরি কখনো হাত তালি কখনো দুই আঙুলের তুরি দিচ্ছে।
এভাবে ৪৫ মিনিট পার করার পরে আমরাই শংকিত হয়ে গেলাম যে নিওমোনিয়া বা ঠান্ডা না লেগে যায়. পরে আমরাই তাকে তুললাম, জুয়েল পানি থেকে উঠে পুকুরের চারিদিকে এত লোক দেখে লজ্বিত হল। ও পানিতে থাকা অবস্থায় ছোটো ভাই ইলিয়াসকে দিয়ে কাঁটাবন টুংকিং চাইনিজ থেকে থেকে কর্নসুপ আর অন্থন আনানো হলো। জুয়েল উঠে ফ্রেশ হয়ে গোগ্রাসে সুপ আর অন্থুন খেলো।
আমি নির্মল লিটু ঘটনার আকস্মিকতায় একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি। জুয়েল সুপ খেয়ে রেস্ট নিলো,রেস্ট থেকে উঠেই জুতা কিনে দিতে বললো সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় ঐ দিন আর তার জুতা কিনে দেওয়া হলো না। পরেরদিন ইংরেজী বাংলা দৈনিকে জুয়েলের পানির নীচে থাকার সংবাদ প্রকাশিত হল।
পরের দিন থেকে জুয়েলের জুতার বায়না আমরা বলি তুমি সেলিব্রেটি হয়ে গেছো,সামান্য জুতার জন্য তোমার এ বায়না ঠিক তোমার ইমেজের সাথে যায় না। ফাইনালি জুয়েলকে আর জুতা কিনে দেওয়া হয় নাই। ছাত্রজীবন শেষ করে পারিবারিক জীবনে জুয়েল যখন সাতক্ষিরা চলে গেলো ঢাকা আসলে আমার বাসায়ই উঠতো। প্রতিবারই সাতক্ষিরা’র কিছু না কিছু নিয়ে আসতো, কখনো চিংড়ি মাছ কখনো ঘোষ ডেইরীর সন্দেস কখনো পানি কচু ডিম নিয়ে আসতো।
ঐ সময়েও মাঝে মাঝে রাগ করে বলতো তোরা আমাকে ৪৫ মিনিট পানির মধ্য রেখে আমাকে জুতা কিনে দিস নাই,এ সব বলে নির্মল লিটু আমাদের বকাবকি করতো। আমি হাসতে হাসতে বলতাম দোস্ত তোমাকে এক জোড়া জুতা নয় তোমাকে জুতার ফ্যাক্টরীতে নিয়ে যাবো যত খুশী নিও। পরবর্তীতে অনেক জুতাই কিনে দিয়েছি কিন্ত ঐ বাজীতে জিতে যাওয়া জুতা না পাওয়ার বেদনা জুয়েল ভুলতে পারে নাই।
আগেই বলেছি আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন ছিলো ভ্রাতৃত্ববোধের চেয়েও সুদৃঢ় যা এখনো বিদ্যামান। যুগ যুগ অনুকরনীয় হয়ে বেঁচে থাকুক আমাদের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব। আসলে জুয়েল ছিলো বহু গুনে গুনান্বিত একজন পরিপূর্ন মানুষ। অন্য এপিসোডে আরো লিখবো আশা রাখি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। দোয়া চাই জুয়েলের বিদেহী আত্মার জন্য ও জুয়েলের পরিবারের জন্য।
পোস্ট প্রসংগেঃ আজকে কুইকটিভিবিডি.কম এর ”ফেসবুক কর্নার”এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র,মুহসিন হল ছাত্র সংসদের সাবেক এজিএস, বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, সুপ্রিমকোর্ট শাখার সাধারণ সম্পাদক এডঃ কামরুল ইসলাম সজল এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে পোস্টটি সংগ্রহ করা হয়েছে। এডঃ সজল নিয়মিতভাবে তাঁর চমৎকার লেখনীর মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে থাকেন।
বিপুল/১৮.০৫.২০২২ খ্রিস্টাব্দ/বিকাল ৩.২০