
ডেস্ক নিউজ : তিনি শুধু একজন ধর্মীয় নেতা নন; ছিলেন শিক্ষাবিদ, নৈতিকতার দিকনির্দেশক, সমাজসংস্কারক এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা। তাঁর শিক্ষা–পদ্ধতি ছিল সহজ, গভীর, মানবিক এবং সময়োপযোগী। যার শিক্ষায় গড়ে উঠেছিল এমন এক প্রজন্ম, যারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে, অন্ধকারচ্ছন্ন সমাজকে আলোর পথ দেখিয়েছিল। তাই বলা হয়, তিনি শুধু ‘জ্ঞানদাতা’ নন, বরং ‘জীবনের শিক্ষক’। তার শিক্ষা পদ্ধতি আজও বিশ্বমানের যেকোনো শিক্ষকতার মডেল হিসেবে কার্যকর।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। ছিলেন ছাত্রদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব। তারা তাঁকে ভালোবাসতেন, নিজের চেয়েও বেশি। তিনিও তাদের ভালোবাসতেন। তাদের সঙ্গে মিশতেন, রসিকতা করতেন। সাহাবীরা তাঁর কাছে মন খুলে নিজের সব কথা বলতেন। আর নবীজি একজন পিতার মতো তাদের সবকিছু শেখাতেন। আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিতেন খুব সহজ ভাষায়, যাতে অশিক্ষিত মানুষও বুঝতে পারে। তিনি দ্রুত বা জটিল ভাষায় কথা বলতেন না।আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন-রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা এত সুস্পষ্ট ছিল যে প্রত্যেক শ্রোতা তাঁর কথা বুঝত (আবু দাউদ : ৪৮৩৯)। তিনি আরো বলেন-রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে কথা বলতেন যদি কোনো গণনাকারীর গণনা করতে ইচ্ছা করে তবে সে গুনতে পারবে (মুসলিম : ৭৩৯৯)
এই হাদীস আজকের শিক্ষকদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমাদের অনেক শিক্ষক এমন আছেন, যারা ছাত্রদের সামান্য ভুলও ক্ষেপে যান, তাদের তিরস্কার করেন। ফলে এটাকে কেন্দ্র করে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, কখনো তা বেয়াদবিতে রূপ নেয়। অথচ শিক্ষক যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন, তবে হয়তো এমনটা হতো না। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিতেন উদাহরণ,ও উপমা দিয়ে, যা বিষয়কে মনে গেঁথে দিত। যেমন, তিনি বললেন— এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য অট্টালিকার ন্যায়, যার এক অংশ অন্য অংশকে মজবূত করে রাখে। তারপর তিনি (বুঝাবার জন্য) তাঁর এক হাতের আঙ্গুলগুলিকে অপর হাতের আঙ্গুলগুলির ফাঁকে ঢুকালেন। (বুখারি ৪৮১, মুসলিম ৬৭৫০)
আরেকটি হাদিস শুনুন!হযরত আবুযর গিফারি রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একবার শীতের সময় যখন গাছের পাতা ঝরে পড়ছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে তশরীফ আনলেন এবং একটি গাছের দুটি ডাল ধরে ঝাঁকি দেয়া শুরু করলেন, এবং ঝরঝর করে (শুকনো) পাতা পড়তে লাগলো। তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আবু যর! যখন কোন মুসলমান একনিষ্ঠ হয়ে আন্তরিকতার সাথে নামায পড়ে, তখন তার গুনাহ ঠিক এভাবে ঝরে পড়ে, যেমন এ গাছের পাতাগুলো ঝরে পড়ছে।(মুসনাদে আহমদ: ২১৫৯৬)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তি পরিস্থিতি হিসেবে শিক্ষা দিতেন। যেমন-কোনো ব্যক্তি এসে জানতে চাইল, কোন আমল সবচেয়ে উত্তম ?তখন নবীজি পরিস্থিতি ও ব্যক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিয়েছেন, কখনো সালাত, সদকা, হজ। কখনো জিহাদ, কখনোবা পিতা–মাতার সেবা।অর্থাৎ ব্যক্তিকে যে বিষয়ে কমতি দেখতেন। তাকে সেই কাজ করার দিকনির্দেশনা দিতেন। কিংবা যখন যে পরিস্থিতি আসতো। তখন সে কাজ করার দিকনির্দেশনা দিতেন। যাতে ব্যক্তি সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু উপদেশ দিতেন না; নিজেই ছিলেন তার সর্বোত্তম অনুসরণযোগ্য উদাহরণ।কোরআনে বলা হয়েছে
নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রয়েছে রাসূলের উত্তম আদর্শ। (সূরা আহজাব, আয়াত:২১) তিনি যেসব নৈতিকতা শেখাতেন, সত্যবাদিতা, নরম ব্যবহার, দানশীলতা, ক্ষমাশীলতা, বিনয়। তিনি নিজেই ছিলেন সেগুলোর প্রতিমূর্তি । অতএব, তাঁর শিক্ষা শুধু কথার নয়; কর্মের শিক্ষা।শিক্ষার্থী প্রশ্ন করলে নবীজি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। অতঃপর উত্তর দিতেন, কখনো উপহাস করতেন না। কিন্তু কখনো কখনো নিজেই প্রশ্ন করে শিক্ষা দিতেন।
শিক্ষক হিসেবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন, এক অনন্য প্রতিভা ও অনুপম আদর্শ। তিনি কোমলতা, ধৈর্য, উদাহরণ, ভালোবাসা, যুক্তি, প্রশ্নোত্তর, দৃষ্টান্ত, বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার এবং ব্যবহারিক আচরণের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর শিক্ষা ছিল মানবিক, নৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও বাস্তবসম্মত, যা আজকের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আয়শা/০৪ ডিসেম্বর ২০২৫,/রাত ৮:৩০






