শেখ হাসিনাঃ ভারতের শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা
—————————————————————-
১৫ বছরের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিরোধীদের দমন-পীড়নের প্রতিবাদে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের দাবি, শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। কিন্তু ৭৬ বছর বয়সী হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে হলে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য প্রতিবেশীদের কাছে ভারতের অবস্থান ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করে ভারত।
বিরোধ সমাধান বিষয়ক থিংকট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের টমাস কিন বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারত স্পষ্টতই শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায় না। এর ফলে নয়াদিল্লির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা এই অঞ্চলের অন্যান্য নেতাদের কাছে একটা বার্তা পাঠানো হবে, যে শেষ পর্যন্ত, ভারত আপনাকে রক্ষা করবে না। বিষয়টা ভারতের জন্য খুব ইতিবাচক হবে না।
কিন্তু ভারত তার ব্যবসা বাণিজ্য আর আধিপত্যবাদকে খুব গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষের জনপদে ভারতের বিশাল মার্কেট। এই মার্কেট হাতছাড়া হলে ভারতের বিরাট আর্থিক ক্ষতি দেখা দিবে। সেই সংগে ভৌগোলিক ভাবে ভারতের পেটের মাঝে অবস্থান করা বাংলাদেশে ভারতের কর্তৃত্ব বজায় না থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ভারতের জন্যেই তা চিন্তার বিষয়।
শেখ হাসিনার পতনের পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও মন্দিরের ওপর কিছু হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার নিন্দাও জানানো হয়েছে বাংলাদেশের আন্দোলনকারী ও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু ভারতের সরকারের সমর্থক বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে এসব ঘটনার অতিরঞ্জিত বিবরণ দেশটিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ছড়িয়েছে। এবিষয়ে ভারতের উপুর্যপরি অতিরঞ্জিত প্রচারণায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে শীতল এক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এখনো প্রকাশ্যে নয়াদিল্লির কাছে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করেনি। কিন্তু কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করার কারণে নয়াদিল্লির কাছে একটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে অবস্থান করা হাসিনার অন্য কোনো দেশে যাওয়াটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৩ সালে একটি দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছিল। এর অধীনে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার সুযোগ রয়েছে। তবে চুক্তির একটি ধারায় অপরাধ ‘রাজনৈতিক চরিত্রের’ হলে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের সুযোগও দেওয়া হয়েছে দুই দেশকে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী এএফপিকে বলেন, শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার চাপ দেওয়ার চেয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষা বাংলাদেশের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো বুদ্ধিমান সরকার বুঝতে পারবে, হাসিনার ভারতে থাকার বিষয়টিকে ইস্যুতে পরিণত করা তাদের জন্য কোনো সুবিধা তৈরি করবে না।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় ইতোমধ্যে ভারত বেকায়দায় পরে গেছে। শেখ হাসিনাকে ভারতে থাকতে দিলে ভারতের কিছুই অর্জন হবেনা। উল্টো বাংলাদেশের সংগে শীতল সম্পর্কটা দীর্ঘায়িত হবে। আবার শেখ হাসিনাকে ভারত ছেড়ে চলে যেতে বললে, ভারত সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে যে, ভারত তার মিত্রের দুর্দিনে চোখ উলটিয়ে দেয়। ভারতের এই শ্যাম রাখিনা কূল রাখি অবস্থা কতদিন চলবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে ভারত কোন সুবিধাজনক অবস্থায় যে নেই তা সহজেই বোঝা যায়।
লেখকঃ লুৎফর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। তিনি নিয়মিত লেখালেখির পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক নিউজ মিডিয়ার সম্পাদক ও প্রকাশক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র লুৎফর রহমান ৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস তুলে ধরতে চারটি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় জীবনের খন্ডচিত্র এঁকে তিনি এখন ব্যাপক পরিচিত পাঠক মহলে।
বিপুল/০২.০৯.২০২৪/ রাত ৯.৩৫