পতনশীল পুঁজিবাজারে নীরবতা, সবাই কি দর্শক ?
———————————————————–
বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে প্রতিদিনই কমছে সূচক । সবার মুখে একই প্রশ্ন ধারাবাহিক এই পতনের শেষ কোথায়?
প্রতিবেশী দেশ ভারত কিংবা দেউলিয়া থেকে ফিরে আসা শ্রীলংকার পুঁজি বাজারে আজ রমরমা অবস্থা। ক্রমাগত সংঘাত লেগে থাকা পাকিস্তানের কেএসএ সূচকও ঊর্ধ্বমুখী। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাতেও যখন সারাবিশ্বের পুঁজিবাজার স্থিতিশীল,তখন বাংলাদেশে কেন প্রতিদিন পতনের রেকর্ড !
আলু পেঁয়াজের দাম বাড়লেও হৈ চৈ পরে যায় অথচ পুঁজি বাজারের ক্রমাগত দর পতন লাখো মানুষের হাহাকারে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।কেন এই পতন ? কেন সবাই মুখে কুলূপ এটে বসে আছে ? কথা বললেই নাকি সরকারের বিপক্ষের লোক বলে তকমা দেওয়া হয়। ভীষণ অপ্রিয় এই তকমা কেউ গায়ে লাগাতে চান না বলেই নিরুপায় এই নীরবতাকে পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে প্রচণ্ড লসে নিজের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে কাঁদতে কাঁদতে মার্কেট ছেড়ে যাচ্ছেন লাখো বিনিয়োগকারী। তাদের আশঙ্কা শেয়ার বাজার বিলুপ্তির পথে, কদিন পর ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ৯৬’ সালের ভয়াবহ ধ্বসের পর বছরের পর বছর লেগেছিল আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবার কি হবে ? মার্কেট কি অচিরেই ক্রেতা শূন্য হতে যাচ্ছে ??
বিনিয়োগকারীদের মতে ৯৬’ এবং ২০১০, ২০১৯ এর থেকেও বেশী পতন হয়েছে ২০২৪ এ। কিন্তু অজানা কারণে কেউ টুঁ শব্দটি করছেন না।
বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ হতাশা থেকেই এই চরম আস্থাহীনতার উৎপত্তি। আইপিওর মাধ্যমে একের পর এক সাইন বোর্ড সর্বস্ব দুর্বল কোম্পানির শেয়ার লিস্টেড করা সহ নানা অনিয়ম নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদূরদর্শিতা মুহুর্মুহু নীতির পরিবর্তন, সাংঘর্ষিক নীতির প্রণয়ন এবং মার্কেট নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে পক্ষপাতমূলক আচরণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে দূরে সরে যাচ্ছেন ক্রমাগত। ২০১০ এর ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারী এখন ১৭ লাখে এসে ঠেকেছে।
চোখে কান্না নিয়ে একজন বিনিয়োগকারীর আক্ষেপ ”রক্ষক যদি ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সেখানে আস্থা রাখি কিভাবে।” এই ভক্ষকদের পেট সত্যিই কি এতো বড় যে ভরবে না সহসাই। আগে যে কোম্পানি গুলোকে লিস্টিং না করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাম্প্রতিক সময়ে সেগুলোকেও লিস্টিং এর অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ রক্ষায় আইন প্রণয়ন হচ্ছে।পুঁজির এই বাজারে বিনিয়োগকারী নয় ব্যক্তি স্বার্থই প্রাধান্য পাচ্ছে।
আগের থেকে অনেক বেশী বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা আর লোক দেখানো বৈঠক দেখে মার্কেটে ঝাঁপিয়ে পরেন না বরং তারা দুরভিসন্ধির গন্ধ খুঁজেন। যতবারই মিটিং হচ্ছে ততোবারই মার্কেটের পতন আরও বেশী ত্বরান্বিত হচ্ছে। তাদের অভিযোগ সঠিক তদারকির অভাবে জবাবদিহিতা না থাকায় মার্কেটে স্বচ্ছতার ঘাটতি প্রচণ্ড। এক সময়কার অর্থমন্ত্রী আবুল আল আব্দুল মুহিতের ভাষ্যকে সত্য প্রমাণিত করে আজকের এই বাজার কেবলই ফটকা আর জুয়ার বাজারে পরিণত হয়েছে।
মিটিং এ তারা মৌখিক নির্দেশ তো দিচ্ছেন কিন্তু লিখিত কোন কংক্রিট নির্দেশনা থাকছে না।মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে কিনতে বলেছেন কিন্তু তারপরের কোন ফলোআপ নেই। ক্লোজ এন্ড মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে ওপেন এন্ড করে দেওয়াতে মূলত কাদের স্বার্থ রক্ষা হয়েছে ? যারা বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ডের ক্ষেত্রে ক্রমাগত লস দেখিয়ে ঠকিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কি কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ? মিউচুয়াল ফান্ডের এসেটমেনেজমেন্ট কোম্পানির তদারকি করে যারা তাদের কোন দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতা নেই আজও।
সময় এসেছে ঘোষণা দেওয়ার আর কোন নাম সর্বস্ব দুর্বল কোম্পানি বাজারে লিস্টেড হবে না। লিস্টেড কোম্পানি মানে বিনিয়োগকারীদের টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশের বিলিসিতার জীবন নয় অসাধু এই চক্রকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার বিরুদ্ধে যে বৈষম্য মূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছে কর্মের মাধ্যমে নিরপেক্ষতা দিয়েই তা ভুল প্রমাণ করতে হবে।
মার্কেটের গভীরতা বাড়ানোর অজুহাতে একের পর এক দুর্বল কোম্পানির শেয়ার লিস্টেড হচ্ছে আর তারল্য প্রবাহ কমে যাচ্ছে। বিশাল মার্কেট মানে ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের সমতা।মার্কেট নতুন কোন ক্রেতা তৈরী করতে না পারলেও নতুন শেয়ার আসতে আসতে বাজারকে শুষ্ক করে ফেলেছে।
কম দামে শেয়ার বিক্রি করে যারা মার্কেট বিমুখ হচ্ছেন বা সাইড লাইনে চলে যাচ্ছেন তাদের বেশীরভাগই সাধারণ মানুষ । আর কিছুতেই ফিরে আসবেন না ।পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ ছিল চাকুরীজীবী,বেকার,পেনশন ভোগী, গৃহিণী সহ সবার । কেবল প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ দিয়ে চার বিলিয়নের মার্কেট চালনা করা সম্ভব নয়।
নতুন কোম্পানি লিস্টিং এর মাধ্যমে সুচতুর কৃত্রিম উপায়ে সূচক তো ঠিক থাকছে কিন্তু বাজারের লেনদেন প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে।
বন্ধ হওয়া লিজিং কোম্পানিতে শেয়ার হোল্ডারদের অধিকার রক্ষায় কোন নির্দেশনা নেই। ব্যাঙ্ক কোম্পানি একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে শেয়ার হোল্ডারদের অবস্থান নিয়ে সুস্পষ্ট কোন রূপ রেখা নেই ।
বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে ডিমিউচুয়ালাইজড যে স্টক এক্সচেঞ্জ নতুন আঙ্গিকে গঠিত হল এই ক্রান্তিকালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেক্টর,শেয়ার হোল্ডার ডিরেক্টরদের নিষ্ক্রিয়তায় তাদের ভূমিকা এবং ডিমিউচালাইজড প্রক্রিয়া আজ প্রশ্ন বিদ্ধ ।
ব্রোকার এসোসিয়েশন যাদের হওয়ার কথা ছিল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, তাদেরও দৃশ্যমান কাজের কোন অগ্রগতি নেই, কেবলই অকর্মণ্য সংগঠন।
গুটি কয়েক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে আগে মতিঝিলের রাস্তায় স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে ব্যানার ফেস্টুন হাতে প্রতিবাদ করতে দেখা যেত অজানা কারণে তারাও নিশ্চুপ।শেয়ার বাজার সংশ্লিষ্ট সবাই কি তবে সময়ের প্রবাহে বোবা কালা অন্ধ হয়ে গেছে ! নাকি কারো কোন দায় নেই !
সাম্প্রতিক সময়ে লিস্টেড বেক্সিমকো জিরো কুপন বন্ড ১৫% ইন্টারেস্ট ঘোষণা করার সাথে সাথে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে ভেবেছে সবাই বুঝি শেয়ার ছেড়ে নিশ্চিত লাভের বন্ডে বিনিয়োগ করবে।২০২১ সালে ৭০০০ ইনডেক্সের রমরমা বাজারে সুকুক বন্ড ৩ হাজার কোটি টাকা তোলার ঘোষণা দেওয়ার পর মার্কেটের পতন শুরু হয় এবং স্বল্প সময়ে ১০০০ পয়েন্ট কমে যায়। সেই জুজুর ভয়ে আক্রান্ত অনেকের মনেই ভয় এবারো অনেক কমে যাবে।
অর্থনৈতিক পর্যালোচনা করলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কটের কারণে ইন্টারেস্ট রেট অনেক বেশী। বললেই কেউ ব্যাংক ছেড়ে অস্থিতিশীল পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ করতে আসবে না। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সর্ব প্রথম প্রয়োজন পুঁজি রক্ষার নিশ্চয়তা।প্রতিদিনের এই পতন থামাতে না পারলে যা অসম্ভব। সামনে বাজেটে পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কিছু সুখবর সংযোগ করেও অপ্রদর্শিত অর্থ মূল ধারায় ফেরানো যায় সেই সাথে পুঁজি বাজারকে উজ্জীবিত।
অনেকে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের কথা বলছেন । প্রধানমন্ত্রী একাই যদি সব সামাল দিতে হয় অন্যরা তবে কেন আছেন ? ডিএসই ও সিএসই এর কর্মকর্তাগণ জনগণের টাকায় রোড শো এর নামে ইংল্যান্ড, দুবাই, কাতার, মরিশাসের মত দ্বীপ রাষ্ট্রে মূলত হানিমুন করতে যান। অথচ একজন বিনিয়োগকারীও পুঁজি বাজারে আনতে পারেনি তারা। এই অর্বাচীনতার শেষ কোথায় ?
-বিপ্লব রহমান।
ঢাকা।
ইমেইল : brahmandac88@gmail.com